ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ৩ পৌষ ১৪৩২

পেঁয়াজ আমদানিতেও চক্রের দ্বিগুণ মুনাফা, ক্ষতির মুখে কৃষক-ভোক্তা

নিজস্ব প্রতিবেদক

 প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৮, ২০২৫, ১১:৩৮ দুপুর  

ছবি: সংগৃহিত

মুড়িকাটা পেঁয়াজের মৌসুম চলছে। কয়েক বছর লোকসানের পর এবার ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার স্বপ্ন দেখছিলেন চাষিরা। কিন্তু ঠিক এই সময়েই পেঁয়াজের বাজারে তৈরি হয়েছে অস্থিরতা। বাজারসংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, আমদানিকারক ও পাইকারি পর্যায়ের একটি শক্তিশালী চক্র কৃত্রিম সংকট তৈরি করে পেঁয়াজের দামে অস্বাভাবিক উল্লম্ফন ঘটাচ্ছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, দেশে এখনও আগের মৌসুমের প্রায় এক লাখ টন পেঁয়াজ মজুত রয়েছে। নতুন মৌসুমের পেঁয়াজও বাজারে আসতে শুরু করেছে। সব মিলিয়ে সরবরাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকার কথা। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে তার উল্টো চিত্র।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ভারত থেকে আমদানি করা পেঁয়াজ কেজিপ্রতি সব খরচ মিলিয়ে দেশে আসছে প্রায় ৫০ টাকায়। অথচ সেই পেঁয়াজই খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১১০ থেকে ১৩০ টাকায়। অর্থাৎ আমদানিকারক ও পাইকারি পর্যায়ে দ্বিগুণের বেশি মুনাফা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে।

চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ ও ঢাকার বিভিন্ন পাইকারি বাজারে অভিযান চালিয়ে আমদানিমূল্য ও বিক্রয়মূল্যের বড় ব্যবধানের তথ্য পেয়েছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। সংস্থাটি জানিয়েছে, অনিয়ম প্রমাণিত হলে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, পর্যাপ্ত মজুত থাকার পরও পেঁয়াজের দাম কৃত্রিমভাবে বাড়ানো হয়েছে। কৃষকের স্বার্থ উপেক্ষা করে একটি অদৃশ্য শক্তির চাপে সরকার আমদানির অনুমতি দিতে বাধ্য হয়েছে। তাঁর মতে, আমদানিকারকরা কত দামে পেঁয়াজ আনছেন এবং কত দামে বিক্রি করছেন, এই তথ্য প্রকাশ করা হলে বাজার দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আসবে।

দাম নিয়ন্ত্রণে সরকার আমদানির অনুমতির সংখ্যা বাড়িয়েছে। সোম ও মঙ্গলবার প্রতিদিন ৫৭৫টি করে আমদানি অনুমতি (আইপি) ইস্যু করা হয়। প্রতিটি আইপির বিপরীতে সর্বোচ্চ ৩০ টন পেঁয়াজ আমদানির সুযোগ দেওয়া হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত এক সপ্তাহে ভারত থেকে ১৯ হাজার ৫০০ টন পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে।

কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, বাস্তবে পেঁয়াজের কোনো ঘাটতি নেই। দেশে মোট উৎপাদন প্রায় ৪৪ লাখ টন, যেখানে বার্ষিক চাহিদা প্রায় ২৮ লাখ টন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আগেই জানিয়েছিল, পেঁয়াজের দাম ১৫০ টাকা ছাড়ালে আমদানির অনুমতি দেওয়া হবে। এই সুযোগ কাজে লাগাতে একটি সিন্ডিকেট ইচ্ছাকৃতভাবে সংকট তৈরি করে দাম বাড়িয়েছে বলে অভিযোগ তাঁদের।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সরেজমিন উইংয়ের অতিরিক্ত পরিচালক (মনিটরিং ও বাস্তবায়ন) ড. মো. জামাল উদ্দীন বলেন, আমদানির অনুমতি আদায়ের জন্য একটি চক্র ইচ্ছাকৃতভাবে বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। দেশের বিভিন্ন গুদামে এখনও এক লাখ টনের বেশি পেঁয়াজ মজুত রয়েছে।

তিনি জানান, গত বছর প্রায় চার লাখ টন এবং তার আগের বছর সাড়ে সাত লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করা হয়েছিল। কিন্তু এবার উৎপাদন ভালো হওয়ায় এখন পর্যন্ত মাত্র ১২ হাজার ৯০০ টন আমদানি হয়েছে। সংরক্ষণ সুবিধা বাড়ানো গেলে দেশের উৎপাদন আরও স্থিতিশীল করা সম্ভব।

বাজার সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা, অতিরিক্ত আমদানির চাপ দিলে এর সুফল ভোক্তারা পাবেন না, বরং ক্ষতিগ্রস্ত হবেন কৃষকরা। কারওয়ান বাজারের আড়তদারদের মতে, নতুন পেঁয়াজ পুরোপুরি বাজারে এলে কেজিপ্রতি দাম ১০০ টাকার নিচে নেমে আসার কথা।

এদিকে বেশি দামের আশায় রাজধানীসহ বিভিন্ন এলাকায় পাতাসহ অপরিপক্ব পেঁয়াজ বিক্রি হতে দেখা যাচ্ছে। অনেক কৃষক পুষ্ট হওয়ার আগেই পেঁয়াজ তুলে ফেলছেন। কৃষি কর্মকর্তাদের আশঙ্কা, এতে ভবিষ্যতে প্রকৃত সংকট তৈরি হতে পারে। অপরিপক্ব পেঁয়াজ পরিপক্ব হলে ওজনে বেশি হতো এবং দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা যেত।

পেঁয়াজ উৎপাদনের জন্য পরিচিত পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার বায়া গ্রামের কৃষক মাহফুজুর রহমান বলেন, ভালো দাম পাওয়ার আশায় তিনি পরিপক্ব হওয়ার আগেই মুড়িকাটা পেঁয়াজ তুলছেন। তাঁর মতো অনেক কৃষকই একই সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এস এম সোহরাব উদ্দিন বলেন, বাজারে ভালো দাম দেখে কিছু কৃষক অপরিপক্ব পেঁয়াজও তুলে আনছেন, এতে সামগ্রিক উৎপাদনে প্রভাব পড়ছে। মাঠপর্যায়ে কৃষকদের সচেতন করার চেষ্টা চলছে।

কৃষি সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান বলেন, পেঁয়াজের বাজার স্থিতিশীল রাখতেই সীমিত পরিসরে আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে। মোট চাহিদার তুলনায় আমদানির পরিমাণ খুবই কম। এতে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না এবং ইতোমধ্যে দাম কমতে শুরু করেছে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

বাংলাধারা/এসআর