জুলাই সনদ বাস্তবায়নে দুই বিকল্প খসড়া সুপারিশ ঐকমত্য কমিশনের
প্রকাশিত: অক্টোবর ২৯, ২০২৫, ১০:৩৩ দুপুর
ছবি: সংগৃহিত
চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের পর গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ- ২০২৫’-এর দুটি বিকল্প খসড়া সুপারিশ জমা দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে। মঙ্গলবার সকালে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে এ সুপারিশ হস্তান্তর করেন কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ।
দুটি প্রস্তাবের মূল লক্ষ্য, ‘জুলাই সনদ’কে সাংবিধানিক রূপ দেওয়া এবং সংবিধান সংস্কারের রূপরেখা নির্ধারণ। তবে বাস্তবায়নের ধরনে কিছু পার্থক্য রেখেছে কমিশন।
প্রথম প্রস্তাবে বলা হয়েছে, আগামী সংসদের সংবিধান সংস্কার পরিষদ ২৭০ দিনের মধ্যে সংস্কার সম্পন্ন না করলে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রণীত সংবিধান সংশোধনের খসড়া বিল স্বয়ংক্রিয়ভাবে পাস বলে গণ্য হবে। দ্বিতীয় প্রস্তাব অনুযায়ী, পরিষদকে একই সময়সীমার মধ্যে জুলাই সনদের নির্দেশনা অনুযায়ী সংস্কার সম্পন্ন করতে হবে।
কমিশনের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, কোন সুপারিশ কার্যকর হবে, তা ঠিক করবে সরকার।
দুটি খসড়াতেই বলা হয়েছে, আদেশের ওপর গণভোট অনুষ্ঠিত হবে। আদেশ জারি থেকে নির্বাচনের দিন পর্যন্ত যেকোনো সময় এ ভোট অনুষ্ঠিত হতে পারে। গণভোটে থাকবে একটিমাত্র প্রশ্ন, জনগণ ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোটে মতামত দেবেন।
গণভোটে আদেশ অনুমোদিত হলে আগামী সংসদ হবে ‘দ্বৈত ভূমিকাসম্পন্ন’, অর্থাৎ এই সংসদই সরকার গঠন করবে, আইন ও বাজেট প্রণয়ন করবে, পাশাপাশি ‘সংবিধান সংস্কার পরিষদ’ হিসেবে কাজ করবে। পরিষদ জুলাই সনদের নীতিমালা অনুযায়ী সংবিধানের মৌলিক কাঠামো সংস্কার করবে।
কমিশনের সুপারিশকে ‘বিতর্কিত’ বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, “ঐকমত্য কমিশন জাতীয় ঐক্যের পরিবর্তে অনৈক্যের পথে যাচ্ছে।”
জামায়াতে ইসলামীও প্রস্তাবটিকে স্বাগত জানায়নি। দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ বলেছেন, “গণভোট নির্বাচনের আগে হওয়া উচিত।”
অন্যদিকে, এনসিপির নেতারা আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া না জানালেও সাংবিধানিক আদেশ জারি করে গণভোট আয়োজনের প্রস্তাবকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন।
কমিশনের খসড়ায় প্রস্তাব করা হয়েছে, সংবিধান সংস্কার সম্পন্নের ৪৫ দিনের মধ্যে নিম্নকক্ষের ভোটসংখ্যার আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে (PR পদ্ধতি) উচ্চকক্ষ গঠন করা হবে। তবে বিএনপি এবং তাদের মিত্রজোটগুলো এই পদ্ধতির ঘোর বিরোধী।
অন্যদিকে, জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন ও এনসিপিসহ কয়েকটি দল অন্তত উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতি চায়।
বিএনপি বলেছে, তারা নির্বাচনে জয়ী হলে পিআর পদ্ধতিসহ নোট অব ডিসেন্ট দেওয়া সংস্কারগুলো বাস্তবায়ন করবে না। তবে অন্যান্য দলগুলোর দাবি, গণভোটে জনগণ যেভাবে মত দেবে, সেভাবেই সব সংস্কার কার্যকর করতে হবে।
কমিশনের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, আদেশ অনুমোদিত হলে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের নিয়েই গঠিত হবে সংবিধান সংস্কার পরিষদ। স্পিকার পরিষদের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। সংস্কার শেষে পরিষদ বিলুপ্ত হবে।
প্রথম খসড়ায় সংস্কার বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে, যেখানে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পরিষদ কাজ শেষ না করলে অন্তর্বর্তী সরকারের খসড়া বিলই কার্যকর হবে। দ্বিতীয় খসড়ায় সংস্কার প্রক্রিয়াকে ‘নির্দেশনামূলক’ রাখা হয়েছে, অর্থাৎ পরিষদকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজ সম্পন্ন করতে বলা হলেও তা বাধ্যতামূলক নয়।
কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, “সংবিধান সংস্কার পরিষদ ইচ্ছেমতো পরিবর্তন আনতে পারবে না। তাদের কাজ জুলাই সনদের নীতিমালার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে।” তিনি আরও বলেন, “কন্সটিটুয়েন্ট ক্ষমতা দেওয়া হলেও সেটি নিয়ন্ত্রিত, জুলাই সনদই তাদের পথনির্দেশক হবে।”
গণভোটে আদেশ অনুমোদিত না হলে তা জনগণের প্রত্যাখ্যান হিসেবে গণ্য হবে বলে ব্যাখ্যা দেন আলী রীয়াজ। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন, ৩১ অক্টোবরের মধ্যে সব রাজনৈতিক দল, বিশেষত এনসিপি, সনদে সই করবে।
প্রধান উপদেষ্টাকে সুপারিশ হস্তান্তরের পর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ, সদস্য বিচারপতি এমদাদুল হক, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. বদিউল আলম মজুমদার, ড. মো. আইয়ুব মিয়া, সফর রাজ হোসেন এবং প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের এই প্রস্তাবের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হলো- জুলাই সনদের বাস্তবায়ন এখন আর কেবল রাজনৈতিক অঙ্গীকার নয়; এটি রূপ নিচ্ছে এক সাংবিধানিক প্রক্রিয়ার খসড়ায়।
বাংলাধারা/এসআর
