সিএনএনের প্রতিবেদন
শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডে সবচেয়ে বড় বাধা ভারত
প্রকাশিত: নভেম্বর ২৪, ২০২৫, ১২:২০ দুপুর
ফাইল ছবি
বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দেওয়া মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে চায় ঢাকা। মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সাম্প্রতিক রায়ে তার এই সর্বোচ্চ শাস্তি নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে এই রায় কার্যকরের পথে এখন সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ভারত- যেখানে তিনি গত বছরের আগস্ট থেকে আত্মগোপনে আছেন। মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন এক প্রতিবেদনে এই জটিল ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতির বিশদ বিশ্লেষণ করেছে।
দেশের রাজনীতিতে তিন দশকেরও বেশি সময় প্রভাব বিস্তারকারী শেখ হাসিনা একসময় ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতীক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ কন্যা হিসেবে তিনি ছোটবেলা থেকেই রাজনীতির অস্থিরতা ও বৈরী পরিবেশের ভেতর বড় হন। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এক সামরিক অভ্যুত্থানে পরিবারের অধিকাংশ সদস্যকে হারানোর পর শুরু হয় তার দীর্ঘ নির্বাসন জীবন। সেসময় পশ্চিম জার্মানিতে থাকায় তিনি ও তার বোন শেখ রেহানা প্রাণে বেঁচে যান।
পরবর্তী ছয় বছর ভারত থাকাই তার রাজনৈতিক জীবন ও ভবিষ্যৎ কূটনৈতিক সম্পর্ককে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে তিনি আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তখন তার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠেন আরেক শক্তিশালী রাজনৈতিক চরিত্র- খালেদা জিয়া। এরপর শুরু হয় বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বহুল আলোচিত ‘দুই বেগমের রাজনীতি’।
১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা। একটি মেয়াদ পরে ক্ষমতা হারালেও ২০০৮ সালে আবার নির্বাচিত হন এবং টানা পনেরো বছর দেশের শাসনক্ষমতায় থাকেন। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বড় পরিবর্তন এলেও তার শাসনামলে মানবাধিকার লঙ্ঘন, বিরোধী দলের ওপর দমন-পীড়ন ও সংবাদমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের অভিযোগও ব্যাপকভাবে ওঠে।
আঞ্চলিক রাজনৈতিক বাস্তবতায় ভারতের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কও অনেক সময় সমালোচনার জন্ম দেয়। বিশেষ করে নিকট প্রতিবেশীর নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষায় দিল্লির ওপর তার অতিরিক্ত নির্ভরতার অভিযোগও ছিল প্রবল।
২০২৪ সালে সরকারি চাকরির কোটা সংস্কার ইস্যুতে শুরু হওয়া ছাত্র আন্দোলন দ্রুত দেশব্যাপী গণবিক্ষোভে রূপ নেয়। সরকারের কঠোর দমন-পীড়নে জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী ১,৪০০ মানুষ নিহত হয়। সহিংসতা থামেনি, বরং আন্দোলন আরও তীব্র হয়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত গণঅভ্যুত্থানের মুখে তাকে ক্ষমতা ছাড়তে হয় এবং ভারত পালিয়ে গিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় নেন।
বাংলাদেশি বিশ্লেষক মুবাশ্বর হাসান বলেন, “দেশত্যাগই ছিল তার অপরাধের স্বীকারোক্তি। তিনি এমন এক সীমা অতিক্রম করেছিলেন, যেখান থেকে আর ফিরে আসা সম্ভব হয়নি।”
ভারতে অবস্থান করেই তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা হয়। অভিযোগ ছিল- বিক্ষোভকারীদের ওপর হত্যাযজ্ঞ পরিচালনার নির্দেশ দেওয়া, ড্রোন ও ভারী অস্ত্র ব্যবহার করে আন্দোলন দমন, এবং ফাঁসির নির্দেশ প্রদান।
রায় ঘোষণার সময় আদালত কক্ষে নিহতদের পরিবার কান্না ও করতালিতে প্রতিক্রিয়া জানায়। এক শহীদ ছাত্রের বাবা আবদুর রব বলেন, “রায়ের মাধ্যমে কিছুটা শান্তি পেলাম। পূর্ণ শান্তি তখনই আসবে, যখন তাকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলতে দেখব।”
ভারত এই রায়কে স্বীকৃতি দিলেও নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েছে। তবে দেশটির আইন এবং বাংলাদেশ-ভারত প্রত্যর্পণ চুক্তি অনুযায়ী ‘রাজনৈতিক অপরাধে’ কাউকে ফেরত না পাঠানোর বিধান রয়েছে। ভারতের সাবেক কূটনীতিক অনিল ত্রিগুনায়েত মনে করেন, “ভারত তাকে ফেরত পাঠাবে- এমন সম্ভাবনা খুবই কম।” তার মতে, ভারত এই মামলাকে রাজনৈতিক অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করতে পারে।
এছাড়া শেখ হাসিনার কাছে এখনো সুপ্রিম কোর্টে আপিল বা আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে যাওয়ার সুযোগ আছে, তাই দিল্লি কোনো তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত নেবে না বলেই তিনি মনে করেন।
বাংলাদেশ ইতিমধ্যে তাকে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবিতে ভারতকে নতুন করে কূটনৈতিক চিঠি পাঠিয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভাষ্য, “হাসিনাকে ফিরিয়ে দেওয়া ভারতের দায়িত্ব।”
আগামী ফেব্রুয়ারির নির্বাচন সামনে রেখে শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ড এখন দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতির অন্যতম বড় বিষয়। বর্তমানে নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব অনিশ্চিত। অন্যদিকে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার রাজনৈতিক উত্তাপ কমানোর কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। এই পরিস্থিতিতে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল আবারও ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ পাচ্ছে।
এখন প্রশ্ন- শেখ হাসিনার পতন কি বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে একটি বিতর্কিত যুগের অবসান ঘটাবে, নাকি নতুন অস্থিরতার দরজা খুলে দেবে?
বাংলাধারা/এসআর
