ঢাকা, শুক্রবার, ১৮ জুলাই ২০২৫, ৩ শ্রাবণ ১৪৩২

দেশের নিরাপত্তা খাত সংস্কারে র‍্যাব বিলুপ্তির আহ্বান, বিচারহীনতার অভিযোগ জাতিসংঘের

নিজস্ব প্রতিবেদক

 প্রকাশিত: জুলাই ০৯, ২০২৫, ১১:৪৬ দুপুর  

ফাইল ছবি

নিরাপত্তা খাত সংস্কারের অংশ হিসেবে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব) বিলুপ্তির বিষয়টি বাংলাদেশ সরকারকে অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে। একইসঙ্গে, বাহিনীর যেসব সদস্য জোরপূর্বক গুমে যুক্ত নন, তাদের নিজ নিজ বাহিনীতে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে। এ ছাড়া প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরকে (ডিজিএফআই) শুধুমাত্র সামরিক গোয়েন্দা কার্যক্রমের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার ওপরও জোর দিয়েছে জাতিসংঘের ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এনফোর্সড অর ইনভলান্টারি ডিজঅ্যাপিয়ারেন্সেস (ডব্লিউজিইআইডি)।

গত জুনের মাঝামাঝি সময়ে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ সফর করে ডব্লিউজিইআইডির দুই সদস্যের একটি কারিগরি প্রতিনিধি দল। সফরকালে তারা প্রধান উপদেষ্টা, সেনাপ্রধান, পররাষ্ট্র ও আইন উপদেষ্টা, পুলিশ কর্মকর্তা, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের (আইসিটি) কৌঁসুলি, গুম কমিশন এবং গুমের শিকার ব্যক্তি ও তাদের পরিবারের সঙ্গে বৈঠক করেন। ফিরে গিয়ে তারা বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে, যা গত ২৫ জুন সরকারের কাছে পাঠানো হয়েছে।

ডব্লিউজিইআইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে অধিকাংশ জোরপূর্বক গুমের ঘটনার পেছনে র‍্যাবের ভূমিকা রয়েছে। পাশাপাশি বিভিন্ন সময় ডিজিএফআইও এসব ঘটনায় সম্পৃক্ত হয়েছে। র‍্যাব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন পুলিশের একটি বিশেষ ইউনিট, যেখানে সেনা ও পুলিশ সদস্যরা একসঙ্গে কাজ করেন। আর ডিজিএফআই প্রধানমন্ত্রীর অধীন সামরিক গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালনা করে।

এর আগে গুম কমিশন, জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের তথ্যানুসন্ধান দল এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)ও গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র‍্যাব বিলুপ্তির সুপারিশ করেছিল।

ডব্লিউজিইআইডির মতে, দেশে জোরপূর্বক গুমের ঘটনায় দায়মুক্তির প্রবণতা উদ্বেগজনক। প্রতিবেদনে বলা হয়, “সেনাবাহিনী, ডিজিএফআই, র‍্যাবসহ সব নিরাপত্তা বাহিনীর উচিত চলমান তদন্তে সম্পূর্ণ সহযোগিতা করা এবং প্রকৃত জবাবদিহির প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকা। তবেই ভুক্তভোগী ও জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনা সম্ভব।”

প্রতিবেদনটি আরও উল্লেখ করেছে, গুমের শিকার ব্যক্তিরা বিচার প্রক্রিয়ার ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না। কারণ, গুমের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযুক্ত অনেকেই এখনও নিজেদের দায়িত্বে বহাল আছেন। ডব্লিউজিইআইডি বলেছে, “দায়মুক্তির সংস্কৃতির পুনরাবৃত্তি রোধে রাষ্ট্রের উচিত সামগ্রিকভাবে যাচাই-বাছাই করে গুমের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের নিরাপত্তা বাহিনী এবং অন্যান্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান থেকে অপসারণ করা।”

এই প্রতিবেদনের সুপারিশ সম্পর্কে জানতে চাইলে র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক উইং কমান্ডার এম জেড এম ইন্তেখাব চৌধুরী বলেন, “জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর বাহিনীর মধ্যে ইতোমধ্যে সংস্কার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। র‍্যাব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সরকারি আদেশে। সুতরাং, সরকার চাইলে র‍্যাবে থাকা সেনা, নৌ, বিমান, বর্ডার গার্ড, পুলিশ, কোস্টগার্ড ও আনসার সদস্যরা নিজ নিজ বাহিনীতে ফেরত যেতে পারবেন। সরকার যেমন নির্দেশ দেয়, র‍্যাব তেমন কাজ করে।”

তিনি বলেন, “র‍্যাবের অনেক ভালো কাজও রয়েছে। তবে অতীতে যে অন্ধকার অধ্যায় ছিল, তার পুনরাবৃত্তি যেন না হয়, সে জন্য কঠোরভাবে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। প্রয়োজনে বাহিনীর কার্যপরিধির সংস্কার করে নির্ধারণ করা যেতে পারে, র‍্যাব কী করবে, কতটুকু করবে বা কী করবে না।”

র‍্যাব বিলুপ্তির বিষয়টি নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যেও মতভিন্নতা দেখা দিয়েছে। জুলাই-পরবর্তী বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংস্কার নিয়ে “আফটার দ্য মনসুন রেভল্যুশন: এ রোডম্যাপ টু লাস্টিং সিকিউরিটি সেক্টর রিফর্ম ইন বাংলাদেশ” শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)। পশ্চিমা দেশগুলোর কূটনীতিকদের কাছেও এ প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়েছে।

র‍্যাব বিলুপ্তি নিয়ে কিছু ইউরোপীয় কূটনীতিকের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। সমকালকে একাধিক কূটনীতিক জানিয়েছেন, র‍্যাব গঠনের পেছনে পশ্চিমা দেশগুলোরই ভূমিকা ছিল। কারণ, গ্লোবাল সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় বিশেষ বাহিনী গঠনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছিল। তবে একই সঙ্গে র‍্যাবের বিরুদ্ধে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগও উঠেছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক পশ্চিমা কূটনীতিক বলেন, “র‍্যাব যেমন ভয়াবহ অপরাধ দমন করেছে, তেমনি নিজেরাও ভয়ঙ্কর অপরাধে লিপ্ত হয়েছে। র‍্যাব বিলুপ্ত হলে দেশের অপরাধ দমনে বড় শূন্যতা তৈরি হবে। ইতোমধ্যেই জুলাই-পরবর্তী আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অস্থিতিশীল। র‍্যাব না থাকলে জনগণের নিরাপত্তাবোধ কমতে পারে। অপরাধীরা ভিন্ন বার্তা পাবে। বরং বাহিনীর সংস্কারের দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত।”

এইচআরডব্লিউ ব্রিফিংয়ে উপস্থিত আরেক পশ্চিমা কূটনীতিক বলেন, “শেখ হাসিনার আমলে নিরাপত্তা বাহিনী রাজনৈতিক প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখান থেকে সংস্কার করাটা খুব কঠিন হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য এটি বড় চ্যালেঞ্জ। র‍্যাবকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করে জবাবদিহি নিশ্চিত করা সহজ কাজ নয়। এমনকি ৫ আগস্টের পরেও র‍্যাবের অপরাধ ঢাকার প্রবণতা দেখা গেছে। অভিযোগ আছে, তারা তাদের ‘আয়নাঘর’ নামের নির্যাতন কেন্দ্রগুলো ধ্বংস করে আলামত নষ্ট করেছে।”

ওই কূটনীতিক আরও বলেন, “রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় ফিরলে র‍্যাব আবার আগের রূপে ফিরে যাবে না- এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। কারণ, যেই সরকারই ক্ষমতায় আসুক, র‍্যাবকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে।”


বাংলাধারা/এসআর