ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৩ মে ২০২৫, ৩০ বৈশাখ ১৪৩২

পুঁজিবাজারে আস্থা সংকট: সংস্কারের গতি নেই, বিনিয়োগকারীদের হতাশা বাড়ছে

নিজস্ব প্রতিবেদক

 প্রকাশিত: মে ১০, ২০২৫, ০৪:০০ দুপুর  

ফাইল ছবি

দীর্ঘমেয়াদী অচলাবস্থায় পুঁজিবাজার। একের পর এক প্রতিশ্রুতি, বৈঠক, উদ্যোগ- সবকিছু মিলিয়েও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার সংকট কাটছে না। অর্থনীতিবিদ ও বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, গত ১৬ বছরে ধারাবাহিক অব্যবস্থাপনা ও রাজনৈতিক প্রভাবের ফলে দেশের শেয়ারবাজার কার্যত তলানিতে পৌঁছেছে। অথচ এই অবস্থা থেকে উত্তরণে এখনো পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো পরিকল্পনা কিংবা স্বল্পমেয়াদী প্রণোদনা গ্রহণ করা হয়নি।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০১০ সালের ভয়াবহ পতনের পর থেকে দেশের পুঁজিবাজার আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। এর আগে ১৯৯৬ সালের ধস থেকেও বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন, কিন্তু সময়ের ব্যবধানে কিছুটা পুনরুদ্ধার হয়েছিল। তবে ২০১০ সালের পতনের পর থেকে আজ পর্যন্ত যেটুকু উন্নতির দেখা গেছে, সেটি ছিল ক্ষণস্থায়ী এবং তা মূলত রাজনৈতিক প্রভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

বিশ্লেষকদের ভাষায়, "পতিত আওয়ামী শাসনামলে" পুঁজিবাজার হয়ে পড়ে দুর্নীতির অন্যতম ক্ষেত্র। সালমান এফ রহমান, খায়রুল ও শিবলী কমিশনারসহ একাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বাজার থেকে হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। ভঙ্গুর ও অবিশ্বস্ত কোম্পানির তালিকাভুক্তির কারণে বিনিয়োগকারীরা সম্পূর্ণভাবে আস্থা হারায়।

৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর শেয়ারবাজারে কিছুটা প্রাণ ফিরে আসে। সূচক মাত্র তিন দিনের ব্যবধানে ১,০০০ পয়েন্টের বেশি বেড়ে যায়। বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ফিরে আসে আশার ঝিলিক। অনেকেই ধরে নেন, একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে এবার হয়তো বাজারে গঠনমূলক সংস্কার আসবে।

কিন্তু সেই প্রত্যাশাও দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। পরবর্তী ১৫১টি লেনদেন দিনের মধ্যে ১০০ দিনের বেশি সময় বাজার সূচক নিম্নমুখী ছিল। আবারও হাজার পয়েন্টের বেশি হারিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে নেমে আসে হতাশা।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন বলেন, এই মুহূর্তে বাজারে স্বল্পমেয়াদী প্রণোদনা প্রয়োজন ছিল। বিগত ১৫ বছরে যেভাবে বাজারের প্রতি অবিচার করা হয়েছে, তা কাটিয়ে উঠতে হলে আস্থা ফেরানো দরকার। সেটা হতে পারে নগদ সহায়তা, নীতিগত পরিবর্তন, অথবা বাজারে ইতিবাচক বার্তা দিয়ে।’

তিনি আরও জানান, ১১ মে প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে অর্থ মন্ত্রণালয় ও বিএসইসির বৈঠকে পুঁজিবাজার ইস্যু আলোচনার কথা থাকলেও, সেখানে বাজার সংশ্লিষ্টদের রাখা হয়নি। এতে বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্তের সম্ভাবনা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

বর্তমান সরকারের অধীনে গঠিত শেয়ারবাজার সংস্কার টাস্কফোর্সের আওতায় ১৭টি বিষয় চিহ্নিত করা হলেও, ৯ মাসে মাত্র তিনটি বিষয়ে প্রস্তাবনা এসেছে। সময়ক্ষেপণ আর দুর্বল বাস্তবায়ন পরিকল্পনা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার সংকট আরও বাড়িয়ে তুলেছে।

অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, মূল সংস্কারের ক্ষেত্রে এখনও তেমন কিছু দেখা যায়নি। এখানে আইনি সংস্কার জরুরি, বিএসইসির অভ্যন্তরীণ কাঠামোগত পরিবর্তন জরুরি। সংস্কারগুলো দৃশ্যমান না হলে মানুষ আশাবাদী হবে না।’

সরকারি সূত্র বলছে, আসন্ন বাজেট বা তার আগেই পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট একাধিক সিদ্ধান্ত আসতে পারে। কিছু দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ নেয়া হবে বলে জানানো হয়েছে।

প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী আনিসুজ্জামান চৌধুরী বলেন, আমরা সেক্টরভিত্তিক রিপোর্টগুলোর ভিত্তিতে একটা সামগ্রিক ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি করছি। দ্রুত বাস্তবায়নযোগ্য সুপারিশগুলো আগে কার্যকর করার চেষ্টা থাকবে। তবে সবকিছু একসাথে সম্ভব না, কারণ লোকবলেরও অভাব রয়েছে।’

বিশ্লেষকরা বলছেন, শেয়ারবাজার নিয়ে যেসব সংস্কার প্রয়োজন, তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতা নয় বরং কার্যকর সময়সীমা নির্ধারণ জরুরি। বাজারের বাস্তবতা বুঝে ধাপে ধাপে সংস্কার বাস্তবায়নেই ফিরতে পারে আস্থা।

পুঁজিবাজার শুধু একটি আর্থিক ক্ষেত্র নয়- এটি মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের সঞ্চয়ের অন্যতম জায়গা। সেখানে প্রতারণা ও অব্যবস্থাপনা চলতে থাকলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে জনগণ, আর তা দেশের অর্থনীতির উপরও পড়বে বিরূপ প্রভাব।