শুল্ক আলোচনায় নতুন শর্ত: শ্রম অধিকার সুরক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রের চাপ
প্রকাশিত: জুলাই ১৯, ২০২৫, ০৭:৪১ সকাল

প্রতীকি ছবি
বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য সম্পর্কের নতুন আলোচনায় এবার শ্রমিক অধিকারও যুক্ত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র প্রায় দুই দশক ধরে বাংলাদেশের শ্রম খাতের কার্যকর সংস্কারের ওপর জোর দিয়ে আসছে। তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ড এবং রানা প্লাজা ধসের পর বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা স্থগিত করে দেশটি। সেই সুবিধা ফেরত আনার চেষ্টা অব্যাহত থাকলেও এবার শুল্কহার নির্ধারণের আলোচনাতেও শ্রম অধিকারের বিষয়টি যুক্ত করেছে ওয়াশিংটন।
সম্প্রতি ওয়াশিংটনে তিন দিনব্যাপী বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র শুল্ক আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনায় উভয় দেশ বর্তমান ও ভবিষ্যতের বাণিজ্য কাঠামো নিয়ে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরে। কিছু বিষয়ে সমঝোতা হলেও বেশ কিছু বিষয় রয়ে গেছে অমীমাংসিত। শিগগিরই আবারও আলোচনায় বসবে দুই দেশ।
ঢাকা ও ওয়াশিংটন সূত্রে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্র চাইছে বাংলাদেশে এমন আইন প্রণয়ন করতে, যাতে বাধ্যতামূলক বা জোরপূর্বক শ্রমের মাধ্যমে তৈরি কোনো পণ্য আমদানি করা না যায়। এটি যুক্তরাষ্ট্রের ১৯৩০ সালের শুল্ক আইনের আদলে কার্যকর করার প্রস্তাব দিয়েছে দেশটি।
এছাড়া, শ্রমিকদের সমাবেশ ও দরকষাকষির অধিকার সুরক্ষায় শ্রম আইন সংশোধনের তাগিদ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। শ্রম ইউনিয়ন নিবন্ধনে ২০ শতাংশ শ্রমিকের বাধ্যতামূলক অংশগ্রহণ কমিয়ে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) প্রস্তাবিত ১৫ শতাংশে নামাতে বলা হয়েছে। শ্রমিকদের কারখানা ও জাতীয় পরিচয়পত্র বা জন্মসনদ প্রদানের বাধ্যবাধকতাও শিথিল করার দাবি তুলেছে তারা।
শ্রমিক ইউনিয়নবিরোধী কার্যক্রম ও অন্যায্য শ্রমচর্চা রোধে জরিমানার পরিমাণ এমন পর্যায়ে বাড়াতে হবে, যাতে মালিকপক্ষ এ ধরনের কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকে। একই সঙ্গে শ্রমিকদের কালো তালিকাভুক্ত করা যাবে না এবং ইউনিয়ন ও শ্রমিকদের আদালতে মামলা করার সুযোগ দিতে হবে। শ্রমিকদের ধর্মঘটের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে এবং অবৈধ ধর্মঘট হলেও তাদের জেল-জরিমানা করা যাবে না।
যুক্তরাষ্ট্র বলছে, রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে (ইপিজেড) শ্রমিকদের ইউনিয়ন গঠনের অধিকার দিতে হবে। ধর্মঘটের অধিকারও নিশ্চিত করতে হবে এবং অবৈধ ধর্মঘট হলেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না।
২০২৩ সালের ন্যূনতম মজুরি আন্দোলনসহ বৈধ শ্রম ইউনিয়ন বা আন্দোলনে যুক্ত থাকার কারণে শ্রমিক নেতা ও তৈরি পোশাকশিল্প শ্রমিকদের বিরুদ্ধে থাকা ফৌজদারি মামলাগুলো দ্রুত সমাধান বা বাতিল করার শর্ত দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। পাশাপাশি প্রতি তিন বছর অন্তর স্বচ্ছ ও নিয়মিত মজুরি পুনর্মূল্যায়নের ব্যবস্থা করতে বলা হয়েছে।
শ্রমিকদের কার্যকরভাবে সংগঠিত হওয়ার অধিকার সুরক্ষায় ৫৫ দিনের মধ্যে শ্রম ইউনিয়ন নিবন্ধনের আবেদন নিষ্পত্তি করতে হবে এবং আবেদন প্রক্রিয়ার অগ্রগতি অনলাইনে প্রকাশ করতে হবে। শ্রম আইন কার্যকর করতে শ্রম পরিদর্শক সংখ্যা, বাজেট এবং সুবিধা বাড়াতে হবে।
এছাড়া, শিশুশ্রম বা জোরপূর্বক শ্রম প্রতিরোধে ঘোষণা ছাড়াই ইপিজেডসহ যেকোনো কারখানা পরিদর্শন এবং প্রয়োজনে আইনি নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার ক্ষমতা পরিদর্শকদের হাতে দিতে হবে। ভবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করলে জরিমানার পরিমাণ বাড়াতে হবে।
সরকারের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলেন, “বাইডেন প্রশাসন শ্রম অধিকার, মানবাধিকার ও গণতন্ত্রকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। ধারণা ছিল, ট্রাম্প প্রশাসন এসব বিষয়ে ততটা কঠোর হবে না। কিন্তু বর্তমান আলোচনায় দেখা যাচ্ছে, ট্রাম্প প্রশাসনও শুল্ক আলোচনায় সব কৌশল ব্যবহার করছে, শ্রম অধিকারও তার অংশ।”
তিনি আরও বলেন, “শ্রম অধিকার নিশ্চিত করতে বাংলাদেশকে আরও কাজ করতে হবে, এ বিষয়ে দ্বিমত নেই। তবে যুক্তরাষ্ট্র এখন আর আইএলওর পথনকশার দিকে ইঙ্গিত করছে না, বরং সরাসরি নিজেদের শর্ত দিচ্ছে।”
সরকারি এক কর্মকর্তা জানান, শ্রমসংক্রান্ত এই শর্তে চীনও যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্যবস্তু। জোরপূর্বক শ্রমের অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্র বহুদিন ধরে চীনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের শর্ত মেনে নিলে বাংলাদেশ চীনের নিষিদ্ধ প্রতিষ্ঠান থেকে পণ্য আমদানি করতে পারবে না।
বাংলাধারা/এসআর