ঢাকা, শুক্রবার, ১৮ জুলাই ২০২৫, ৩ শ্রাবণ ১৪৩২

গণতন্ত্রের সংকট নির্বাচনে কাটবে, না কি অপেক্ষা করছে আরেকটি বিপর্যয়?

নিজস্ব প্রতিবেদক

 প্রকাশিত: জুন ০৮, ২০২৫, ১২:৩১ রাত  

ছবি: সংগৃহিত

পবিত্র ঈদুল আজহার শুভেচ্ছা জানিয়ে এক ভাষণে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচন আয়োজনের একটি সময়সীমা ঘোষণা করেছেন। তিনি জানান, আগামী বছরের এপ্রিলের প্রথমার্ধে যেকোনো একটি দিনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তবে এই ঘোষণা দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে। বিএনপি ও তাদের কয়েকটি মিত্র দল এই সময়সূচিতে অসন্তোষ জানালেও এনসিপি এবং জামায়াতে ইসলামী এই ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে।

বিএনপি বিগত কয়েক মাস ধরে নির্বাচনকালীন সময়সূচি ঘোষণার জন্য চাপ দিয়ে আসছিল। সেনাবাহিনী প্রধানের কয়েকটি বক্তব্য তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাসও তৈরি করেছিল। এতে অনেকেই ধারণা করেছিলেন, হয়তো অন্তর্বর্তী সরকারের অভ্যন্তরে কোনো ভাঙন তৈরি হতে পারে। তবে বাস্তবতা ভিন্ন চিত্র আঁকে।

এনসিপি এবং জামায়াত নির্বাচন আয়োজনের আগে সংস্কার, বিচার ও "জুলাই সনদ" বাস্তবায়নের দাবি জানিয়ে আসছিল। এনসিপির মতে, সংসদ নির্বাচন নয়, আগে প্রয়োজন সংবিধান সভার নির্বাচন ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন। অন্যদিকে, বিএনপির সুবিধা ছিল- ডিসেম্বরে নির্বাচন আয়োজনের পক্ষে আরও কয়েকটি ছোট-বড় দল ছিল। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার এই দাবিকে আমলে না নিয়ে সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের পথেই এগিয়েছে।

বিএনপির চাপের মুখে সরকার ও এনসিপি পাল্টা জবাব দেয় সংবিধান সংস্কার ও বিচার প্রক্রিয়াকে সামনে এনে। এমনকি, এনসিপি আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে রাজনৈতিক মাঠে নিজেদের অবস্থান আরও জোরালো করে তোলে। বিএনপির ঘুঁটি ভাঙার আরেকটি মোক্ষম পদক্ষেপ ছিল, ইশরাক হোসেনকে মেয়র ঘোষণা ঠেকিয়ে দেওয়া, যা দলটিকে কার্যত কোণঠাসা করে ফেলে।

বিএনপি এরপর চট্টগ্রাম বন্দর ও মায়ানমার মানবিক করিডোর ইস্যুতে মাঠে নামে, যা সরকারকে সাময়িকভাবে ব্যাকফুটে নিয়ে যায়। কিন্তু এরপরও এক অদৃশ্য কারণে বিএনপিকে সরকারের নানা সিদ্ধান্ত মেনে নিতে দেখা গেছে। এটি কি তারেক রহমানের প্রবাসে অবস্থানজনিত দুর্বলতা? নাকি দলটির কৌশলগত কোনো সীমাবদ্ধতা?

যদিও বিএনপি দাবি করে, তাদের ‘৩১ দফা সংস্কার রূপরেখা’ তত্ত্বাবধানে নির্বাচন এবং সুশাসনের ভিত্তি রচনা করতে সক্ষম। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ‘জুলাই সনদ’-এ স্বাক্ষর করলে বিএনপিকে কিছু কঠিন শর্ত মানতে হতে পারে। যেমন: প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ নির্ধারণ, সংসদের কাঠামো পুনর্বিন্যাস, এবং সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের সংস্কার। এই শর্তগুলো বিএনপির ঘোষিত রূপরেখার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতে পারে।

বিএনপি মনে করছে, আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে তারা নির্বাচনে এককভাবে জয়লাভ করতে পারে। কিন্তু জামায়াত, এনসিপি ও অন্যান্য ইসলামি দলগুলো যদি নির্বাচনের পর রাজনৈতিক বন্দোবস্ত না পায়, তাহলে তারা কি বিএনপিকে ফল ভোগ করতে দেবে? এই প্রশ্ন এখন গুরুত্বপূর্ণ।

এদিকে, নির্বাচন কমিশন নিয়ে এনসিপি প্রকাশ্যে সন্দেহ প্রকাশ করেছে- তাদের দাবি, কমিশন নিরপেক্ষতা হারিয়েছে এবং সেটি বাতিল করা দরকার। এই অবস্থায় বিএনপি যদি ‘জুলাই সনদ’-এ স্বাক্ষর করে, তাহলে নিজেই নিজের রাজনৈতিক পায়ের নিচে কুড়াল মারতে পারে।

শ্রীলঙ্কা এবং দক্ষিণ কোরিয়া তাদের রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক সংকট নির্বাচন এবং স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অনেকটাই অতিক্রম করেছে। তবে বাংলাদেশে নির্বাচন কতটা স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য হবে, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়।

বর্তমানে সেনাবাহিনী মাঠে ম্যাজিস্ট্রেসির ভূমিকায় থাকলেও, তাদের অবস্থান সরকার, জামায়াত ও এনসিপির বাইরে বলে প্রতীয়মান হয়নি। বিএনপিকে তাই হয় একাই মাঠে থাকতে হবে, নয়তো সরকারের সাথে চলার পথ খুঁজে নিতে হবে।

তবে সব হারায়নি। ভোটারই বিএনপির আসল শক্তি। যদি তারা কিছু আসনে প্রকাশ্য বা গোপন সমঝোতায় যেতে পারে, তাহলে এখনও ‘বৈতরণি পার’ হওয়ার সুযোগ আছে।

অন্যদিকে, অন্তর্বর্তী সরকারেরও কিছু নিজস্ব এজেন্ডা রয়েছে- বিশেষ করে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবস্থাপনা, রোহিঙ্গা সমস্যা এবং বিচার প্রক্রিয়া। অনেকেই মনে করেন, এই সরকার সেনাসমর্থিত এবং ছাত্র আন্দোলন ও আন্তর্জাতিক মহল (বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তান) তাদের ছায়া সমর্থক।

পরিস্থিতি এখন এমন এক সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে, যেখানে প্রশ্নটা কেবল আওয়ামী লীগের কবর দেওয়া নয়, বরং বিএনপি কি মধ্যপন্থী সরকার গঠন করতে পারবে, নাকি বর্তমান সেনাসমর্থিত জোটের বিস্তার ঘটবে? নির্বাচন আদৌ একটি রাজনৈতিক সমাধান বয়ে আনবে, নাকি ‘জুলাই সনদ’ নতুন সংকটের দ্বার উন্মোচন করবে- সেটাই এখন মূল প্রশ্ন।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ‘আইরনি’ হলো- এখানে মধ্যপন্থীরা বারবার হেরে যায়। আন্তর্জাতিকভাবে জনপ্রিয় হলেও বামপন্থীরা ভোটের রাজনীতিতে প্রান্তিক। ফলস্বরূপ, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসে না এবং সাধারণ জনগণ নির্বাচনের সুফল পায় না।

শেষ পর্যন্ত বলতে হয়, গণতন্ত্র ও নির্বাচন যেন বাংলাদেশে এক দীর্ঘ যাত্রার স্বপ্ন। রাজনৈতিক ঐক্য, অংশগ্রহণমূলক ও নিরপেক্ষ নির্বাচন এবং একটি গ্রহণযোগ্য রূপরেখা ছাড়া এই সংকট কাটবে না। আর তাই, নিজাম উদ্দিন আওলিয়ার স্মরণে বলতে হয়- “নির্বাচন ও গণতন্ত্র হয়তো এখনো বহু দূরের পথযাত্রী!”


বাংলাধারা/এসআর