মাহফুজের স্ট্যাটাস ঘিরে উত্তাল রাজনীতি
জামায়াতের সঙ্গে এনসিপির দ্বন্দ্ব, নাকি কৌশলগত দূরত্ব?
প্রকাশিত: মে ১৩, ২০২৫, ১১:৪৩ রাত

ছবি: সংগৃহিত
একই মঞ্চে দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে আন্দোলন করলেও, দাবি আদায়ের পরপরই প্রকাশ্য বিরোধে জড়িয়েছে জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের ফেসবুক স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে দুই দলের মধ্যে সম্পর্কের টানাপড়েন নতুন মাত্রা পেয়েছে। এতে রাজনৈতিক মহলে প্রশ্ন উঠেছে- এটা কি আদতেই দ্বন্দ্ব, না কি কৌশলগত দূরত্ব তৈরি করে নতুন অবস্থান নিশ্চিতের চেষ্টা?
গত শনিবার রাতেই আওয়ামী লীগের সব রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত জানায় অন্তর্বর্তী সরকার। এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম তার ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে একটি স্ট্যাটাস দেন। সেখানে তিনি লিখেন, "৭১’র প্রশ্ন মীমাংসা করতেই হবে। যুদ্ধাপরাধের সহযোগীদের ক্ষমা চাইতে হবে... পাকিস্তানপন্থা বাদ দিতে হবে..."।
এই স্ট্যাটাসে গোলাম আযম, রাজাকার, শিবির, এবং জুলাই আন্দোলনের প্রসঙ্গ টেনে তিনি জামায়াতকে ইঙ্গিত করেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। এতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানায় জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা। তাদের কেউ কেউ মাহফুজ আলমের পদত্যাগের দাবিও তুলেছেন।
এর আগে ওই স্ট্যাটাসের পর এনসিপির নেতাদের অনেককেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অবস্থান ব্যাখ্যা করতে দেখা যায়। বিশেষ করে এনসিপির ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ- এর নেতারা বিষয়টি নিয়ে সরব হন।
গত বৃহস্পতিবার রাতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে এনসিপি নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। একে একে সেই কর্মসূচিতে যোগ দেয় জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবির, হেফাজতে ইসলাম, ইসলামী আন্দোলনসহ আরও কিছু সংগঠন।
পরদিন বিকেলে অবস্থান কর্মসূচি শাহবাগে স্থানান্তর হলে পরিস্থিতি ঘোলাটে হতে শুরু করে। শাহবাগে গোলাম আযমসহ জামায়াত নেতাদের নামে স্লোগান ও জাতীয় সংগীত গাওয়ার সময় বাধা দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। এ নিয়েই এনসিপি ও জামায়াতের মধ্যে দূরত্ব আরও স্পষ্ট হয়।
এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতারা বলছেন, তারা মধ্যপন্থার রাজনীতিতে বিশ্বাসী এবং কোনো বিতর্কিত স্লোগান বা কর্মকাণ্ডের দায় তারা নিতে রাজি নন।
এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, গণতন্ত্রে মত পার্থক্য থাকবে, কিন্তু সেগুলো যেন দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে না যায় সেটা নিশ্চিত করাটা জরুরি। ৭১-এর প্রসঙ্গে আমরা পরিষ্কার ব্যাখ্যা চাই- আওয়ামী লীগ যেমন মুক্তিযুদ্ধের নাম ভাঙিয়ে রাজনীতি করেছে, তেমনি জামায়াতও তাদের অবস্থান নিয়ে ধোঁয়াশা বজায় রেখেছে।"
অন্যদিকে জামায়াত নেতারা মনে করছেন, মাহফুজ আলম উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই বিভাজন তৈরি করতে চেয়েছেন। জামায়াতের কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান বলেন, একজন উপদেষ্টা হিসেবে মাহফুজ আলমের এমন বক্তব্য শপথের পরিপন্থী। তিনি যদি রাজনৈতিক বক্তব্যই দিতে চান, তবে উপদেষ্টা পদ থেকে সরে গিয়ে সরাসরি রাজনীতি করুন।"
শিবিরের কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি নুরুল ইসলাম সাদ্দাম বলেন, আন্দোলনে হাসনাত আব্দুল্লাহর ভূমিকা নিয়ে প্রশংসা হচ্ছে, সেটা চাপা দিতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিতর্ক তৈরি করা হচ্ছে। মাহফুজ আলমের বক্তব্য আওয়ামী লীগের পুরনো কৌশলের পুনরাবৃত্তি।"
তিনি আরও বলেন, "ফেসবুকে স্ট্যাটাস না দিয়ে যারা শাহবাগে বিতর্কিত কাজ করেছে, তাদের শাস্তির আওতায় আনা উচিত ছিল।"
তীব্র প্রতিক্রিয়ার মধ্যে রোববার মাহফুজ আলম আরও একটি স্ট্যাটাস দেন, যেখানে তিনি লিখেন: আমাকে নিয়ে নোংরামি করতেসো, ঝামেলা নাই... তোমারা তোমাদের পূর্বপুরুষ রাজাকারদের তুলনায় আরও বেশি ভুগবা।"
তবে এই স্ট্যাটাসটি পরে সরিয়ে ফেলেন। যদিও স্ক্রিনশট ইতোমধ্যেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি শুধুই আদর্শগত দ্বন্দ্ব নয়, বরং রাজনৈতিক অবস্থান পরিশুদ্ধ ও শক্তিশালী করতে একটি কৌশলও হতে পারে। একসাথে আন্দোলনে সফলতা আসার পর, কে নেতৃত্বে থাকবে কিংবা কে আগামী দিনে রাজনীতির নিয়ন্ত্রণে থাকবে- তা নিয়ে দ্বন্দ্ব তৈরি হতেই পারে।
একাধিক সূত্র জানিয়েছে, এনসিপির কেন্দ্রীয় পর্যায়ে মাহফুজ আলমের স্ট্যাটাস নিয়ে অভ্যন্তরীণ বৈঠক হয়েছে এবং কেউ কেউ তাকে অনুরোধ করেছেন ভবিষ্যতে এমন বক্তব্য পরিহার করতে।
এদিকে জামায়াত ও শিবিরও নিজেদের মধ্যে বৈঠক করেছে এবং কেউ কেউ আনুষ্ঠানিকভাবে মাহফুজ আলমের পদত্যাগ দাবি করার পক্ষে মত দিয়েছেন।
গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে রাজনৈতিক সমীকরণ এখনো অস্থির ও পুনর্গঠনের মধ্যেই রয়েছে। আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধ হওয়ার পর যে রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হয়েছে, তা পূরণের প্রতিযোগিতায় প্রতিটি দল নিজের অবস্থান পুনঃনির্ধারণে ব্যস্ত। জামায়াত ও এনসিপির এই বিরোধ কৌশলগত অবস্থান পুনর্বিন্যাসের অংশ নাকি সত্যিকারের মতাদর্শিক দ্বন্দ্ব—তা সময়ই বলে দেবে। তবে এতটুকু নিশ্চিত, গণতন্ত্রের পথে নতুন বাংলাদেশের রাজনীতিতে দ্বিধা, দ্বন্দ্ব ও কৌশলের হিসাব আরও ঘন হবে।
বাংলাধারা/এসআর