আন্দোলনের ছায়ায় ‘স্যাবোটাজ লীগ’: অস্থিরতা তৈরিতে নতুন কৌশল
প্রকাশিত: মে ১৬, ২০২৫, ০৬:০১ বিকাল

ছবি: সংগৃহিত
রাজনীতির মাঠে নিষিদ্ধ সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার পরও আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী একটি অংশ এখনো দেশ অস্থিতিশীল করতে মরিয়া। পরিস্থিতি ঘোলাটে করতে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের যৌক্তিক আন্দোলনে ঢুকে তা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করাই এখন তাদের মূল কৌশল। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এই চক্রকে অভিহিত করছেন ‘স্যাবোটাজ লীগ’ নামে।
বিশ্লেষকদের মতে, গত আট মাসে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর শিক্ষার্থী, শিক্ষক, শ্রমিক, চিকিৎসক, এমনকি পরিবহন শ্রমিকদের একের পর এক আন্দোলনকে পুঁজি করে দেশে সুনির্দিষ্টভাবে বিশৃঙ্খলা ছড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে আওয়ামী লীগের একটি চক্র। এ চক্রটি এখন মোবাইল অ্যাপ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং গোপন বৈঠকের মাধ্যমে আন্দোলনকে হাইজ্যাক করে ফ্যাসিবাদী পুনরাবির্ভাবের পরিকল্পনায় লিপ্ত।
সম্প্রতি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষকদের যৌক্তিক দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলনকে কেন্দ্র করে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। আন্দোলনের প্রথম দিনেই পুলিশি লাঠিচার্জ পরিস্থিতি আরও জটিল করে তোলে। রাতেই তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের ওপর পানির বোতল নিক্ষেপ করে কেউ বা কারা বার্তা দিতে চায়—ঘোলা জলে মাছ শিকার চলছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, শিক্ষার্থীদের মতো স্পর্শকাতর আন্দোলনে প্রবেশ করে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা এখন ‘পলাতক আওয়ামী লীগ’ নেতাদের অন্যতম প্রধান কৌশল। এর মাধ্যমে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে একদিকে মাঠ গরম রাখা, অন্যদিকে আন্দোলনকারীদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে দাবি আদায়ের পেছনে রাজনীতির রং লাগানো হচ্ছে।
একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ঢাকার সাম্প্রতিক উত্তপ্ত পরিস্থিতির পেছনে পর্দার আড়াল থেকে নির্দেশনা, অর্থ ও লোকবল জোগাচ্ছে নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের একাংশ। অনলাইন অ্যাপে চলে যোগাযোগ, হোয়াটসঅ্যাপ ও টেলিগ্রামে দেওয়া হয় গোপন বার্তা। আওয়ামী লীগের কিছু ফেসবুক পেজেও মশাল মিছিল, হরতালের আহ্বান ও উসকানিমূলক পোস্ট দেখা গেছে।
বিশ্লেষকদের ভাষায়, অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যর্থতা মানেই গণ-অভ্যুত্থানের স্বপ্ন ভেঙে যাওয়া। তাই সরকারকে অস্থিতিশীল করতে প্রতিটি আন্দোলনে ‘ঘুষে ঢোকার’ কৌশল অবলম্বন করছে পরাজিত ফ্যাসিবাদী শক্তি।
আন্দোলনের নামে আনসার-ভিডিপি, রিকশাচালক, অটোরিকশাচালক, প্যাডেলচালিত চালক, শিক্ষক, চিকিৎসক ও চাকরিজীবীদের ব্যানারে বিভিন্ন দাবি তুলে আনা হচ্ছে, যাতে আন্দোলনের চেহারা বহুমুখী হয়ে যায়। অথচ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আন্দোলনের পেছনে আওয়ামী লীগের সাবেক নেতাকর্মীদের সম্পৃক্ততা দেখা যাচ্ছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এ চিত্রটা একেবারে স্পষ্ট- আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধ ঘোষণার পর তারা ছদ্মবেশে আন্দোলনের মাঠে ঢুকে পড়েছে। কোথাও শিক্ষক, কোথাও শ্রমিক, আবার কোথাও ছাত্র সংগঠনের ব্যানারে গোপন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদল নেতা শাহরিয়ার আলম সাম্যকে মধ্যরাতে নির্মমভাবে হত্যা, গাজীপুরে এনসিপি নেতা হাসনাত আবদুল্লাহর ওপর হামলা, গাইবান্ধায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের তিন নেতার ওপর ছুরিকাঘাত- সবকিছুতেই একাধিক নিষিদ্ধ দলের নেতাকর্মীর সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠেছে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, এসব ঘটনাই প্রমাণ করে- আন্দোলন দমাতে নয়, বরং আন্দোলনের আড়ালে প্রতিশোধ ও ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে স্যাবোটাজ চক্র।
গণফোরামের প্রেসিডিয়াম সদস্য অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেন, “আওয়ামী লীগকে বিদায় জানিয়ে যেসব দল ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল, এখন তারাই বিভক্ত। তাদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ বিরোধের সুযোগ নিচ্ছে আওয়ামী লীগ। ফলে আন্দোলনের শক্তি দুর্বল হচ্ছে, আর চোরাগোপ্তা আক্রমণে লাভবান হচ্ছে পরাজিত শক্তি।”
তিনি আরও বলেন, “দেশে এখন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, মিয়ানমার করিডর ইস্যুতে জনমনে অসন্তোষের যে অবস্থা, সেখানে কোনো আন্দোলন হঠাৎ উত্তপ্ত হয়ে উঠলে বোঝা যাবে—পেছনে সক্রিয় কোনো রাজনৈতিক চক্র রয়েছে।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই বুঝতে হবে, তাদের ব্যর্থতা মানে শুধু সরকারের পতন নয়, বরং একটি সম্ভাব্য গণতান্ত্রিক উত্তরণের ভরাডুবি। এ কারণে প্রতিটি আন্দোলনে ছায়া সংগঠনের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে গোয়েন্দা নজরদারি, ফিল্টারিং ও আন্দোলনের মাঠে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
এছাড়া পুলিশ সদস্যদের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন তারা। কারণ, গত ১৫ বছরে নিয়োগ পাওয়া পুলিশের একটি বড় অংশ আওয়ামী রাজনীতির ঘনিষ্ঠ বলে মনে করা হয়। আন্দোলনের সময় এদের অবস্থান নিয়ে সতর্কতা জরুরি।
বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ‘স্যাবোটাজ লীগ’ নামক ষড়যন্ত্রকারী চক্রটি দেশের রাজনীতি ও সমাজে বিভ্রান্তি ছড়াতে চাইছে বলে অভিযোগ উঠেছে। আন্দোলনকে পুঁজি করে সরকার পতনের চক্রান্ত ঠেকাতে হলে সরকার, সচেতন নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমের সম্মিলিত সচেতনতা জরুরি। নতুবা অচেনা মোড় নিতে পারে দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি।
বাংলাধারা/এসআর