ঢাকা, শুক্রবার, ১৮ জুলাই ২০২৫, ৩ শ্রাবণ ১৪৩২

চট্টগ্রাম বন্দরে অচলাবস্থা: কাস্টমস কর্মবিরতিতে থমকে আছে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম

নিজস্ব প্রতিবেদক

 প্রকাশিত: মে ২৬, ২০২৫, ১১:৩৩ দুপুর  

ছবি: সংগৃহিত

চট্টগ্রাম বন্দরের ইয়ার্ডে জায়গা নেই, সাগরে জাহাজ অপেক্ষমাণ, কাস্টমস ভবনে ফাইলের স্তূপ- সব মিলিয়ে দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক হাব এখন কার্যত অচল। ঈদের আগে এমন অবস্থায় গভীর উদ্বেগে পড়েছেন আমদানিকারক, রপ্তানিকারক, শিল্পমালিকসহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ। কারণ, ১৪ মে থেকে শুরু হওয়া জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিলুপ্তির প্রতিবাদে কাস্টমস কর্মকর্তাদের কর্মবিরতি বর্তমানে এক ভয়াবহ অচলাবস্থার রূপ নিয়েছে।

চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজ, যেখানে প্রতিদিন গড়ে ২০০ কোটি টাকার বেশি রাজস্ব আদায় হয়, এখন শুধুই জনবলের উপস্থিতিতে ‘চালু’- কাজকর্ম প্রায় শূন্যের কোঠায়। গতকাল রোববার দিনভর কোনো শুল্কায়ন হয়নি। অফিসে বসে থেকেছেন কর্মকর্তারা, তবে কলম ছুঁয়ে দেখেননি। কেবল সন্ধ্যার পর সীমিত কিছু শুল্কায়নের কাজ হয়েছে- যা কার্যত নগন্য বলেই উল্লেখ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

এই অচলাবস্থার প্রভাব গিয়ে পড়েছে দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দরেও। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে প্রতিদিন যেখানে গড়ে ৪ হাজার কনটেইনার খালাস হয়, সেখানে গতকাল খালাস হয়েছে মাত্র অর্ধেক। ফলে বন্দরে এখন জমে আছে প্রায় ৪৩ হাজার কনটেইনার- যার বিপরীতে বন্দরের সর্বোচ্চ কার্যকর ধারণক্ষমতা ৪৫ হাজার টিইইউস। ইতোমধ্যে বন্দরসীমায় পণ্যবোঝাই অবস্থায় ১৮টি জাহাজ অপেক্ষা করছে, কারণ কনটেইনার নামানোর জায়গা নেই।

এই কর্মবিরতির সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী উৎপাদনমুখী শিল্প খাত। তৈরি পোশাক শিল্প, ওষুধ খাতসহ আমদানি নির্ভর সব শিল্পেই কাঁচামাল আটকে গেছে বন্দরে। বিজিএমইএর সাবেক সহসভাপতি ও ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরামের চেয়ারম্যান এস এম আবু তৈয়ব জানান, ‘ঈদের আগে এমন অচলাবস্থা আমাদের মারাত্মক ক্ষতির মুখে ফেলছে। কারখানায় কাঁচামাল সময়মতো না পৌঁছালে উৎপাদন ব্যাহত হবে, ফলে রপ্তানি আদেশ সময়মতো রপ্তানি করা সম্ভব হবে না। আর তখন বিদেশি ক্রেতাদের আস্থা হারানোর ঝুঁকিও রয়েছে।’

সরকার গত ১২ মে এক অধ্যাদেশের মাধ্যমে এনবিআর এবং অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ বিলুপ্ত করে ‘রাজস্ব নীতি বিভাগ’ ও ‘রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ’ নামে দুটি নতুন বিভাগ গঠনের ঘোষণা দেয়। এরই প্রতিবাদে এনবিআর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ১৩ মে থেকে ‘সংস্কার নয়, ধ্বংসের প্রক্রিয়া’ দাবিতে আন্দোলনে নামে। শুরু হয় অবস্থান কর্মসূচি, কলমবিরতি। এরপর ১৪ মে থেকে বন্ধ রাখা হয় সব শুল্কায়ন, পরীক্ষণ কার্যক্রম।

২০ মে আলোচনার আশ্বাসে কর্মসূচি স্থগিত হলেও ২১ মে থেকে আবারও পূর্ণাঙ্গ কর্মবিরতির ঘোষণা আসে। বর্তমানে কেবল আন্তর্জাতিক যাত্রীসেবা ও জীবন রক্ষাকারী ওষুধ সরঞ্জামের ক্ষেত্রে আংশিক কার্যক্রম চলছে, বাকিটুকু পুরোপুরি বন্ধ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সমস্যা সমাধানে দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে ঈদের আগে দেশের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম কার্যত ধসে পড়বে। বিশেষ করে ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য এটি ভয়াবহ ধাক্কা হয়ে দাঁড়াবে।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, সাধারণ সময়ে বন্দরে থাকে ৩০ থেকে ৩৩ হাজার কনটেইনার। তবে গত কয়েক মাসে শ্রমিকদের একাধিক কর্মসূচির কারণে কাজ ধীরগতি হয়েছে। সর্বশেষ ১৫ মে শ্রমিকদের ধর্মঘটের পর কনটেইনার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৬ হাজারে। এরপর ১৪ মে থেকে কাস্টমসের পূর্ণাঙ্গ কর্মসূচি শুরুর পর সেই সংখ্যা বাড়তে বাড়তে এখন ৪৩ হাজারে ঠেকেছে।

বন্দরের সচিব ওমর ফারুক বলেন, ‘কাস্টমস কার্যক্রম না হলে বন্দরে কনটেইনার খালাস সম্ভব নয়। আর খালাস না হলে নতুন জাহাজ থেকে কনটেইনার নামানোর কাজও স্থবির হয়ে পড়ে। এতে পুরো বন্দরের কার্যক্রমে প্রভাব পড়ে।’

চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজে প্রতিদিন গড়ে ১০ হাজার আমদানি ও রপ্তানি নথি দাখিল করা হয়। কিন্তু কর্মবিরতির কারণে এসব নথির কোনো কার্যক্রম হচ্ছে না। সিএন্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করছি, অথচ কোনো কাজ হচ্ছে না। কাঁচামাল পড়ে আছে বন্দরে, সময়মতো নিতে না পারলে শিল্প উৎপাদন ব্যাহত হবে, রপ্তানিতেও সমস্যা হবে।’

বিরাজমান সংকটের সমাধান কবে হবে- এই প্রশ্নের উত্তর কারও কাছে নেই। কাস্টমসের কর্মকর্তারা স্বনামে কিছু বলতে না চাইলেও জানান, তারা কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে কর্মবিরতি পালন করছেন। তবে পণ্য আটকে থাকা, শিল্পের ক্ষতি, রাজস্ব আদায়ে ঘাটতির চাপ দিন দিন বাড়ছে।

অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, এভাবে চলতে থাকলে আমদানি-রপ্তানি ঘুরে দাঁড়াতে সময় লাগবে অনেক। একইসঙ্গে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সুনামও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজ ও সমুদ্রবন্দরের অচলাবস্থা এখন শুধু একটি বিভাগীয় সংকট নয়, বরং এটি জাতীয় অর্থনীতির জন্য একটি হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারের উচিত দ্রুত কার্যকর সংলাপ ও সমঝোতার মাধ্যমে সংকট সমাধানের পথ খুঁজে বের করা। না হলে সামনে ঈদের বাজার, আন্তর্জাতিক রপ্তানির সময়সূচি-সবকিছুতেই দেখা দিতে পারে গভীর অস্থিরতা ও ক্ষয়ক্ষতি।

 

বাংলাধারা/এসআর