এনবিআরের শাটডাউনে অচল সারাদেশের বন্দর
প্রকাশিত: জুন ২৯, ২০২৫, ০৭:২০ বিকাল

ছবি: সংগৃহিত
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সংস্কার এবং চেয়ারম্যানের অপসারণ দাবিতে কাস্টমস কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ডাকা ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচির দ্বিতীয় দিনও অচলাবস্থায় রয়েছে দেশের সকল বন্দর। বন্ধ রয়েছে পণ্য শুল্কায়ন, পরীক্ষণ, খালাস ও লোড-আনলোড কার্যক্রম। ফলে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়েছে, চরম ক্ষতির মুখে পড়েছেন ব্যবসায়ী, শ্রমিক এবং সংশ্লিষ্টরা।
এর আগে গত ১২ মে অর্থ মন্ত্রণালয় এক অধ্যাদেশ জারি করে এনবিআর বিলুপ্ত করে রাজস্বনীতি ও ব্যবস্থাপনা বিভাগে ভাগ করার সিদ্ধান্ত নেয়। সেই সিদ্ধান্ত বাতিল ও এনবিআর চেয়ারম্যানের অপসারণের দাবিতে আন্দোলনে নামে এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। ২৫ মে অর্থ মন্ত্রণালয় ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে অধ্যাদেশ সংশোধনের আশ্বাস দিলে আন্দোলন স্থগিত হয়। কিন্তু পুনরায় ২২ জুন থেকে চেয়ারম্যানের অপসারণ দাবিতে কর্মসূচি শুরু হয়।
সারাদেশে শাটডাউনের প্রভাবে দেশের প্রধান প্রধান বন্দরগুলোর চিত্র এমন-
চট্টগ্রাম বন্দর
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের মূল ফটকে তালা ঝুলছে। শাটডাউনের কারণে রপ্তানির জন্য প্রস্তুত তিন হাজার ৬৮০টি কনটেইনার বন্দরে ঢোকানো সম্ভব হয়নি। বেসরকারি কনটেইনার ডিপো সমিতির মহাসচিব রুহুল আমিন সিকদার জানান, “কাস্টমস কর্মকর্তারা না আসায় শুল্কায়ন বন্ধ। তাই কোনো কনটেইনার বন্দরে পাঠানো যাচ্ছে না।”
শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস চেয়ারম্যান শফিকুল আলম জুয়েল বলেন, “কারখানা থেকে পণ্য আসে ডিপোতে, সেখান থেকে শুল্কায়ন শেষে কনটেইনার বন্দরে যায়। শুল্কায়ন বন্ধ থাকায় পুরো রপ্তানি কার্যক্রম থমকে গেছে।”
মেডিটেরানিয়ান শিপিং কোম্পানির হেড অব অপারেশন অ্যান্ড লজিস্টিকস আজমীর হোসেন চৌধুরী জানান, “ডিপো থেকে কনটেইনার না আসায় আমাদের ‘এএস সিসিলিয়া’সহ তিনটি জাহাজ বন্দর ছাড়তে পারছে না।”
আখাউড়া স্থলবন্দর
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া স্থলবন্দরে শাটডাউনের কারণে পণ্য আমদানি-রপ্তানি সম্পূর্ণ বন্ধ। স্থল শুল্ক স্টেশনের রাজস্ব কর্মকর্তা মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, “যাত্রী পারাপার চালু আছে, তবে পণ্য আমদানি-রপ্তানি পুরোপুরি বন্ধ। রোববার ভারতেও ছুটি থাকায় আজও কোনো রপ্তানি হয়নি।”
পণ্য আটকে থাকায় ব্যবসায়ীদের মধ্যে উদ্বেগ বিরাজ করছে। ২১ থেকে ২৬ জুন পর্যন্ত আট কোটি টাকার পণ্য রপ্তানি হলেও গত দুই দিনে কোনো পণ্য রপ্তানি হয়নি।
বেনাপোল স্থলবন্দর
বেনাপোল স্থলবন্দরেও শাটডাউনের প্রভাব পড়েছে সর্বাধিক। কাস্টম হাউস গেটে ঝুলছে শাটডাউনের ব্যানার। পণ্য শুল্কায়ন, পরীক্ষণ, লোড-আনলোড সব বন্ধ। ফলে ভারতের পেট্রাপোল বন্দরের বিপরীতে আটকা পড়েছে প্রায় ৮০০ পণ্যবোঝাই ট্রাক।
বেনাপোল কাস্টমসের রাজস্ব অফিসার আবু তাহের বলেন, “কমপ্লিট শাটডাউনের কারণে আমদানি-রপ্তানি সম্পূর্ণ বন্ধ। সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে, ব্যবসায়ীরা ব্যবসা হারাচ্ছে, শ্রমিকরা কাজ হারাচ্ছে।”
শ্রমিকরা জানান, সকাল থেকে বন্দরে গিয়ে দুপুরেই ফিরে আসতে হয়েছে কাজ না থাকায়। আগে অর্ধদিবস ধর্মঘটে কিছু কাজ হলেও এবার কার্যত সবই বন্ধ।
ভোমরা স্থলবন্দর
সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দরেও চরম স্থবিরতা। গত দুই দিনে সরকারের প্রায় দুই কোটি টাকার রাজস্ব বঞ্চিত হয়েছে। রাজস্ব কর্মকর্তা মিজানুর রহমান জানান, “প্রতিদিন ১০০-১২০টি ট্রাক যাতায়াত করে। শাটডাউনে সব বন্ধ।”
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, অফিস কার্যত ফাঁকা। শ্রমিকেরা কাজের অপেক্ষায় বসে আছেন।
বুড়িমারী স্থলবন্দর
লালমনিরহাটের পাটগ্রামের বুড়িমারী স্থলবন্দরও শাটডাউনে বন্ধ। বন্দরের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং অফিসগুলোতে সুনসান নীরবতা। ব্যবসায়ীরা জানান, বিপরীতে ভারতের চ্যাংড়াবান্ধা বন্দরে পণ্যবোঝাই ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে। পণ্য খালাস ও বোঝাইয়ের কাজে নিয়োজিত শ্রমিক মইদুল ইসলাম বলেন, “কাস্টমের লোকজন কাজ করছে না, বন্দরে গাড়ি আসছে না। কাজ না করলে সংসার চলবে কীভাবে?”
বুড়িমারী সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ফারুক হোসেন বলেন, “দুই দিন ধরে আমদানি-রপ্তানি একদম বন্ধ। বড় ধরনের ক্ষতি হচ্ছে।”
বুড়িমারী শুল্ক স্টেশনের সহকারী কমিশনার রাহাত হোসেন জানান, “শুল্কায়ন কার্যক্রম বন্ধ। আন্দোলন প্রত্যাহার হলে পুরোদমে কাজ শুরু হবে।”
এদিকে, আজ বিকেল ৪টায় অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে আন্দোলনকারীদের বৈঠক হওয়ার কথা থাকলেও অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে, বৈঠক হবে না। অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “কর্মকর্তারা শাটডাউন করতে চাইলে করুক।”
তবে অর্থ উপদেষ্টার দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে, তিনি ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বসবেন।
ব্যবসায়ীরা দ্রুত সমস্যার সমাধান দাবি করেছেন। কারণ চলমান অচলাবস্থা দীর্ঘ হলে দেশের বাণিজ্য, রাজস্ব এবং অর্থনীতির ওপর পড়তে পারে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব।
বাংলাধারা/এসআর