ঢাকা, শুক্রবার, ১৮ জুলাই ২০২৫, ৩ শ্রাবণ ১৪৩২

হেফাজতের মামলা প্রত্যাহার দাবিতে নতুন গতি, ২০১৩’র ঘটনার ২৫টি মামলায় অব্যাহতির সুপারিশ

নিউজ ডেস্ক

 প্রকাশিত: মে ০৭, ২০২৫, ০১:১৩ দুপুর  

ছবি: সংগৃহিত

২০১৩ সালের ৫ মে রাজধানীর শাপলা চত্বরে অনুষ্ঠিত হেফাজতে ইসলামের সমাবেশ ঘিরে সংঘটিত ঘটনায় দায়ের হওয়া শতাধিক মামলার মধ্যে বেশ কিছু মামলায় অব্যাহতির সুপারিশ করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। রাজনৈতিক পালাবদলের পর এ বিষয়ে গতি এসেছে বলে মনে করছে সংশ্লিষ্ট মহল।

কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম রাজধানীর মতিঝিলে ২০১৩ সালের ৫ মে বিশাল সমাবেশের ডাক দেয়। দাবি করা হয়, এটি ছিল শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি। তবে রাত গভীর হলে পুলিশ, র‍্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা অভিযান চালায় সমাবেশকারীদের সরাতে। সেদিন সংঘর্ষে রূপ নেয় পরিস্থিতি। প্রাণহানি ও ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটে।

ওই সময় রাজধানীর পল্টন, মতিঝিল, শাহবাগ, রমনা, মিরপুরসহ চারটি থানায় হেফাজতের বিরুদ্ধে দায়ের হয় মোট ৪৮টি মামলা। এরপর বিভিন্ন সময় হেফাজতের সঙ্গে সরকারের নতুন করে সংঘাতের জেরে মামলার সংখ্যা বাড়তে থাকে। ঢাকা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম ও মুন্সিগঞ্জে মোট ২২০টি মামলা হয় হেফাজতের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে। এর মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেই হয় ৮২টি মামলা, ঢাকায় ৭৩টি, নারায়ণগঞ্জে ২৮টি, চট্টগ্রামে ২৬টি এবং মুন্সিগঞ্জে ১১টি মামলা।

সম্প্রতি রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক মহাসমাবেশ থেকে হেফাজতের শীর্ষ নেতারা এই ২২০টি মামলা পুরোপুরি প্রত্যাহারের দাবি জানান। পরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আনুষ্ঠানিক আবেদনও করে সংগঠনটি।

জানা গেছে, শাপলা চত্বরকেন্দ্রিক ৪৮টি মামলার মধ্যে এখন পর্যন্ত ২৫টিতে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। এসব প্রতিবেদনে হেফাজতের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের সত্যতা না পাওয়ায় তাদের অব্যাহতির সুপারিশ করেছেন তদন্ত কর্মকর্তারা।

সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছিল পল্টন থানায়- ৩৬টি। এর মধ্যে ২২টিতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। বাকি ১৪টি এখনো তদন্তাধীন। মতিঝিল থানায় দায়ের হওয়া ছয়টির মধ্যে দুইটি স্থগিত, দুইটি তদন্তাধীন ও বাকি দুইটিতে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। শাহবাগ থানার চারটি মামলা এবং রমনা থানার একটি মামলা এখনও তদন্তাধীন রয়েছে।

ঢাকার বাইরে ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ অন্য জেলাগুলোর মামলাগুলোতেও অনুরূপ প্রক্রিয়া চলমান। এই পর্যন্ত ১৬টি মামলা পুরোপুরি প্রত্যাহার করা হয়েছে বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও আদালত সূত্র জানিয়েছে।

হেফাজতে ইসলামের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সহকারী আইনবিষয়ক সম্পাদক শরীফ হুসাইন বলেন, “শাপলা চত্বরে আমরা রাসুল (সা.)-এর অবমাননার বিচার চাইতে এসেছিলাম। কিন্তু বিচারের বদলে পেয়েছি গুলি, লাশ আর মিথ্যা মামলা। এখন স্বৈরাচারের পতনের ফলে পুলিশ নিরপেক্ষ তদন্ত করতে পারছে, আর তাতে প্রমাণ হচ্ছে— আমরা নির্দোষ।”

অন্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আব্দুস সালাম হিমেল বলেন, “২০১৩ সালের ঘটনায় হেফাজতের কর্মীদের হত্যা করা হয়েছিল, তারপর উল্টো তাদের বিরুদ্ধেই মামলা দেওয়া হয়। এখন রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তনে এসব মামলা নিরপেক্ষভাবে তদন্ত হচ্ছে। ফলে সত্য উন্মোচিত হচ্ছে— হেফাজত, বিএনপি ও জামায়াতের নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি।”

ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ওমর ফারুক ফারুকী বলেন, “এসব মামলার বেশির ভাগই রাজনৈতিক হয়রানির উদ্দেশ্যে করা হয়েছিল। তদন্তে সত্যতা না পাওয়ায় পুলিশ চূড়ান্ত প্রতিবেদনে আসামিদের অব্যাহতির সুপারিশ করেছে। এখনো কিছু মামলা তদন্তাধীন, তদন্ত শেষে সেগুলোরও নিষ্পত্তি হবে।”

সরকার পতনের পর হেফাজতের পক্ষ থেকেও পাল্টা আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। গত ১৮ আগস্ট শাপলা চত্বরে গণহত্যার অভিযোগ এনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আরও ৩৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন বাংলাদেশ পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান বাবুল সরদার চাখারী। ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত মামলাটি তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন মতিঝিল থানার ওসিকে।

এছাড়া আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালেও গত ২৬ নভেম্বর হেফাজতের পক্ষ থেকে দায়ের করা মামলায় শেখ হাসিনাসহ ৫০ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।

২০১৩ সালের শাপলা চত্বরের ঘটনার এক দশক পর মামলা নিয়ে যে নতুন গতিশীলতা দেখা যাচ্ছে, তা একদিকে যেমন রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রতিফলন, অন্যদিকে দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা মামলাগুলোর বাস্তবতা তুলে ধরছে। হেফাজতের দাবি অনুযায়ী সব মামলা প্রত্যাহার না হলেও যেসব মামলায় অভিযোগের সত্যতা মেলেনি, সেগুলোর অব্যাহতি প্রক্রিয়া আইনি বিচার ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ বলেই বিবেচনা করছেন বিশ্লেষকরা।


বাংলাধারা/এসআর