বিচারকদের বদলি ও পদায়নে আসছে নিয়মশৃঙ্খলা:
সুপ্রিম কোর্টের খসড়া নীতিমালা আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে
প্রকাশিত: মে ০৩, ২০২৫, ১০:৩৬ দুপুর

ছবি: সংগৃহিত
বিচারকদের বদলি ও পদায়নের ক্ষেত্রে দীর্ঘদিনের বিশৃঙ্খলা অবসানের লক্ষ্যে প্রথমবারের মতো সুসংহত নীতিমালা তৈরি করেছে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। খসড়া নীতিমালায় বলা হয়েছে, কোনো বিচারক এক কর্মস্থলে তিন বছরের বেশি সময় থাকতে পারবেন না। পাশাপাশি ভূমি মালিকানা ও আত্মীয়স্বজনের পেশাগত সংশ্লিষ্টতাও পদায়নের ক্ষেত্রে বাধা হিসেবে বিবেচিত হবে।
সম্প্রতি প্রধান বিচারপতির নির্দেশনায় চার পৃষ্ঠার একটি খসড়া নীতিমালা চূড়ান্ত করে আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এটি বাস্তবায়িত হলে অধস্তন আদালতের বিচারকদের বদলি ও পদায়নের প্রক্রিয়ায় কাঙ্ক্ষিত শৃঙ্খলা ফিরবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন বিচার বিভাগ সংশ্লিষ্টরা।
খসড়ায় বলা হয়েছে, কোনো বিচারক এক কর্মস্থলে সর্বোচ্চ তিন বছর এবং উপজেলা পর্যায়ের চৌকি আদালতের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ দুই বছর দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। চাকরি স্থায়ী হওয়ার আগে বিচারককে চৌকি আদালতে পদায়ন করা যাবে না। একই ব্যক্তি একাধিকবার চৌকি আদালতে বদলি বা পদায়ন পাবেন না, তবে ব্যতিক্রম হিসেবে একবার হতে পারে।
তালিকাভুক্ত আরও কিছু বিধান হলো-
* কোনো জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য হিসেবে অন্তত দুই বছর যুক্ত ছিলেন এমন কাউকে পরবর্তী পাঁচ বছর সেই জেলায় বিচারক হিসেবে পদায়ন করা যাবে না।
* বিচারক বা তাঁর স্বামী/স্ত্রী বা সন্তান কোনো জেলায় যদি ৩০ শতাংশের বেশি কৃষিজমি বা ১০ শতাংশের বেশি অকৃষি জমির মালিক হন, তাহলে সেখানে পদায়ন নিষিদ্ধ।
* একইভাবে, যেখানে বিচারকের নিকটাত্মীয় (স্বামী/স্ত্রী, বাবা-মা, ভাইবোন, শ্বশুর-শাশুড়ি) আইন পেশায় জড়িত, সেখানে তাঁকে বদলি করা যাবে না।
* নিজের বা জীবনসঙ্গীর স্থায়ী ঠিকানার জেলায়ও পদায়ন নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
খসড়ায় আরও বলা হয়েছে, বিচারক হিসেবে প্রথম পদায়ন হবে দেওয়ানি আদালতে। এরপর তিনি পালাক্রমে দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালতে বদলি হবেন। দেওয়ানি ও ফৌজদারি—উভয় ধরনের অভিজ্ঞতা ছাড়া কাউকে জেলা আইনগত সহায়তা কর্মকর্তা (LAO) হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যাবে না। সেইসঙ্গে LAO পদের অভিজ্ঞতাও দেওয়ানি আদালতের অভিজ্ঞতা হিসেবে ধরা হবে।
এক কর্মস্থলে একাধিকবার বা পরপর দুইবার পদায়ন নিষিদ্ধ। তবে কেউ পদোন্নতি পেলে, এবং সংশ্লিষ্ট জেলায় পদ খালি থাকলে, পূর্বের কর্মস্থলে আবারও পদায়নের সুযোগ থাকবে।
সূত্র জানায়, বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের পরও বিচারক বদলি ও পদায়নের ক্ষেত্রে নির্বাহী বিভাগের আধিপত্য থেকেই গেছে। গত দেড় যুগ ধরে এ বিষয়ে প্রধান বিচারপতি ও আইন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে একাধিকবার দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে এসেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়েও বদলি-পদায়নে শৃঙ্খলা আসেনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে অন্তত ১৪২ জন বিচারক ঢাকায় বা আশপাশের জেলায় দীর্ঘ সময় ধরে কর্মরত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে সাতজন বিচারক ১৫ বছরের বেশি সময় ঢাকায় ছিলেন। এমনকি, ৪৪ জন বিচারক ১০ বছরের বেশি সময় ঢাকায় থেকে গেছেন। ৮ থেকে ৫ বছরের মধ্যে ঢাকায় কর্মরত ছিলেন আরও ৭৩ জন।
এক নজরে কয়েকটি তথ্য:
* আইন মন্ত্রণালয়ের সদ্য পদত্যাগ করা যুগ্ম সচিব বিকাশ কুমার সাহা প্রায় ২০ বছর ধরে ঢাকাতেই কর্মরত ছিলেন।
* মাঝখানে চট্টগ্রামে বদলি হলেও বছর না ঘুরতেই তিনি আবার ঢাকায় ফিরেছেন।
* ঢাকার বাইরে যেসব বিচারক গিয়েছেন, তাঁদের অনেকেই পরে আবার ঢাকায় ফিরে এসেছেন।
সুপ্রিম কোর্টের অতিরিক্ত জেলা জজ মো. মোয়াজ্জেম হোছাইন বলেন, “জুডিশিয়াল সার্ভিসের সদস্যদের বহুদিনের দাবি ছিল বদলি ও পদায়নে নীতিমালা। প্রধান বিচারপতি গত সেপ্টেম্বরে তাঁর অভিভাষণে এ বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন। আমরা আশা করছি, এ নীতিমালা বাস্তবায়িত হলে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।”
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সংবিধানের ১১৫ অনুচ্ছেদে বিচারকদের নিয়োগের বিষয়ে আলাদা বিধান থাকলেও ১১৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি বা বদলির বিষয়ে এতদিন কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ছিল না। সুপ্রিম কোর্ট এবার সেই ফাঁক পূরণ করতে চায়।
বাংলাধারা/এসআর