ঢাকা, শুক্রবার, ১৮ জুলাই ২০২৫, ৩ শ্রাবণ ১৪৩২

এনআরবি ইসলামিক লাইফ ইন্স্যুরেন্সে দুর্নীতি: তদন্তে উঠে এসেছে কোটি টাকার অনিয়ম

বিশেষ প্রতিবেদক:

 প্রকাশিত: মে ২৬, ২০২৫, ০১:২৪ রাত  

ফাইল ছবি

তিন বছরের মাথায় চরম আর্থিক সংকট ও একাধিক দুর্নীতির অভিযোগে বিতর্কের কেন্দ্রে উঠে এসেছে এনআরবি ইসলামিক লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড। বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)-এর তদন্তে উঠে এসেছে প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ও সিইওসহ শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিপুল অর্থ আত্মসাৎ, অর্থ পাচার এবং বীমা আইনের একাধিক ধারা লঙ্ঘনের প্রমাণ।

নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ ২০২৪ সালের ১০ জুন কোম্পানিটির চেয়ারম্যান বরাবর পাঠানো এক চিঠিতে উল্লেখ করে, প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. শাহ জামাল হাওলাদারের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তার পুনঃনিয়োগের প্রস্তাব নামঞ্জুর করা হয়েছে।

চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, গত তিন অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটি অনুমোদনহীন বীমা পরিকল্প বিক্রি, অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয়, গ্রাহকের প্রিমিয়াম অর্থ অপব্যবহার, ক্যাশ ইন হ্যান্ডের নামে অর্থ আত্মসাৎ এবং কোম্পানির বিনিয়োগ ও তহবিল ব্যবস্থাপনায় জবাবদিহিহীনতা প্রদর্শন করেছে।

আইডিআরএ’র চিঠি অনুযায়ী, ২০২১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত কোম্পানিটি মোট ১০.৭৫ কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয় হিসেবে দেখিয়েছে, যা আইনবহির্ভূত। একই সময়ে বীমা গ্রাহকদের কাছ থেকে সংগৃহীত ৮১.৫২ কোটি টাকার প্রিমিয়ামের মধ্যে অধিকাংশই ব্যয় করা হয়েছে, কিন্তু লাইফ ফান্ডে অবশিষ্ট ছিল মাত্র ১.২০ কোটি টাকা। এতে করে বীমা দাবি পরিশোধে কোম্পানির সক্ষমতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে।

কোম্পানির চেয়ারম্যান কিবরিয়া গোলাম মোহাম্মদ ওরফে জি এম কিবরিয়া, যিনি ইউরোপ আওয়ামী লীগের একজন নেতা বলে পরিচিত, তার বিরুদ্ধে কোম্পানির অর্থ সরবরাহ ও ব্যবস্থাপনায় রাজনৈতিক প্রভাব খাটানোর অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, তার স্ত্রী হোসনে আরা বেগম, যিনি দলীয়ভাবে মহিলা বিষয়ক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, তিনি “ওভারসিজ এজেন্সি ডিরেক্টর” পদে থেকে কমিশনের নামে বিদেশে বিপুল অর্থ পাচার করেছেন।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে কোম্পানির পক্ষ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সিনিয়র কর্মকর্তা জানান, “বহির্বিশ্বে নানা এজেন্সির নামে প্রচুর অর্থ পাঠানো হয়েছে, যেগুলোর কোনও সঠিক হিসাব কোম্পানির ফাইলেও নেই।”

সিইও শাহ জামাল হাওলাদার আইডিআরএ’র পুনঃনিয়োগ বাতিলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে রিট দায়ের করেন। ২০২৪ সালের ২৫ জুলাই হাইকোর্ট এক আদেশে আইডিআরএ’র সিদ্ধান্ত ৬ মাসের জন্য স্থগিত করে এবং তার দায়িত্ব পালনে স্থিতাবস্থা বজায় রাখার নির্দেশ দেন।

তবে আইডিআরএ বিষয়টি চেম্বার আদালতে চ্যালেঞ্জ করে, যেখান থেকে বিষয়টি মূল বেঞ্চে পাঠানো হয়। ৬ মাস পার হলেও মামলাটির চূড়ান্ত নিষ্পত্তি এখনও হয়নি বলে জানা গেছে। আইডিআরএ’র মুখপাত্র মো. সোলায়মান জানান, “আমরা আইনি প্রস্তুতি নিয়েছি। দ্রুতই বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য শুনানিতে যাবো।”

তদন্তে দেখা যায়, “সুরক্ষিত দ্বিগুণ প্রদান এক কিস্তি বীমা” নামে একটি বীমা পলিসি আইডিআরএ’র অনুমোদন ছাড়া বাজারে বিক্রি করা হয়েছে। এই পরিকল্পনা থেকে প্রদত্ত কমিশন অনুমোদিত ৫% এর জায়গায় ৪৫% থেকে ৯৫% পর্যন্ত দেখানো হয়েছে। ফলে অতিরিক্ত কমিশনের নামে প্রায় ১২ কোটি টাকার তহবিল অপচয় হয়।

এছাড়াও, কোম্পানির মোট ১৮ কোটি টাকার পরিশোধিত মূলধনের মধ্যে ৭ কোটি টাকা খরচ করে ফেলা হয়েছে বলে তদন্তে জানা যায়। নিরীক্ষিত ও অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনের বিশ্লেষণে প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক কাঠামোকে 'ঝুঁকিপূর্ণ এবং দেউলিয়া পর্যায়ে' বলে উল্লেখ করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা।

এনআরবি ইসলামিক লাইফ ইন্স্যুরেন্সের ১০ হাজারের বেশি বীমা গ্রাহক রয়েছেন। এদের অধিকাংশই প্রবাসী শ্রমিকদের পরিবারের সদস্য, যারা ‘একক প্রিমিয়াম’ দিয়ে মেয়াদি বীমা করে অর্থ সঞ্চয়ের আশা করেছিলেন। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক অবস্থা ও দাবি পরিশোধে অক্ষমতা গ্রাহকদের অর্থ আদৌ ফেরত পাওয়া নিয়ে আশঙ্কা তৈরি করেছে।

বেসরকারি এক বীমা বিশেষজ্ঞ বলেন, “এই ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলোতে রাজনৈতিক প্রভাব থাকলে নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে গ্রাহকরাই শেষ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়।”

আইডিআরএ ইতোমধ্যে কোম্পানিটির বিরুদ্ধে কয়েকটি সুনির্দিষ্ট অনিয়মের প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছে। তবে আদালতের স্থগিতাদেশের কারণে তা কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করতে পারছে না।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ধরনের পরিস্থিতিতে আইডিআরএ’র উচিত আরও সক্রিয় হয়ে কোম্পানির সম্পদ ও আর্থিক ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা এবং দ্রুত বিচারিক নিষ্পত্তির মাধ্যমে গ্রাহকের স্বার্থ রক্ষা করা।


বাংলাধারা/এএস/এনএ