ঢাকা, শুক্রবার, ১৮ জুলাই ২০২৫, ৩ শ্রাবণ ১৪৩২

বাংলাদেশের ওপর মার্কিন শুল্ক: বাণিজ্যের বাইরে কৌশলগত দরকষাকষি

নিজস্ব প্রতিবেদক

 প্রকাশিত: জুলাই ১৫, ২০২৫, ১০:৩৯ দুপুর  

ছবি: সংগৃহিত

বাংলাদেশি পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবিত ৩৫ শতাংশ শুল্ক কমানো নিয়ে ওয়াশিংটনের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিতীয় দফা আলোচনায় বাণিজ্যের বাইরে ভূ-রাজনৈতিক ও কৌশলগত ইস্যুগুলো প্রধান আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত সপ্তাহে ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে অপ্রকাশ্য বিষয়াদি নিয়েই মূল দরকষাকষি হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে।

ওয়াশিংটন থেকে ফিরে গতকাল সোমবার ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে এক বৈঠকে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বাণিজ্যের বাইরের শর্তগুলোর কথা উল্লেখ করলেও বিস্তারিত কিছু বলতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি জানান, সম্ভাব্য শুল্ক চুক্তির বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের 'নন-ডিসক্লোজার অ্যাগ্রিমেন্ট' (গোপনীয়তার চুক্তি) থাকায় এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করা সম্ভব নয়।

তবে তিনি আশ্বস্ত করেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তৃতীয় পর্যায়ের আলোচনা শিগগিরই শুরু হবে এবং আগামী ১ আগস্টের আগেই একটি যুক্তিসঙ্গত শুল্ক হার নির্ধারণে বাংলাদেশ সক্ষম হবে। উল্লেখ্য, ১ আগস্ট থেকে বাংলাদেশি পণ্যে ৩৫ শতাংশ শুল্ক কার্যকর হবে বলে যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছে, তবে আলোচনার পথ খোলা রাখার কথাও তারা বলেছে।

বাণিজ্য সচিব মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, "পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘোষণা বাংলাদেশের জন্য সম্ভাব্য বড় ধরনের অভিঘাত। আমরা অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে কাজ করছি এবং অংশীজনদের মতামত নিচ্ছি।" বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেমও সরকারের আলোচনার অগ্রগতিতে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র একটি 'ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তি' চাইছে, যার মধ্যে নিরাপত্তা ইস্যুও অন্তর্ভুক্ত থাকবে। এর মূল উদ্দেশ্য হলো, বাংলাদেশ যেন চীনের দিকে অতিরিক্ত না ঝুঁকে। এটি মূলত যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি (আইপিএস)-এর অংশ, যার লক্ষ্য অঞ্চলে অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা সহযোগিতা জোরদার করে চীনের প্রভাব মোকাবিলা করা। শুল্ক আলোচনার সময় যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বাংলাদেশে চীনের বাড়তে থাকা ব্যবসা-বিনিয়োগ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয় এবং দেশটি চায়, বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ উৎসাহিত না করুক।

এ ছাড়া আরও কিছু স্পর্শকাতর শর্ত নিয়ে বাংলাদেশ দরকষাকষি করছে। এর মধ্যে রয়েছে:

মার্কিন নিষেধাজ্ঞা মেনে চলা: যুক্তরাষ্ট্র কোনো দেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিলে বাংলাদেশকেও সেই নিষেধাজ্ঞা মেনে চলতে হবে এবং তাদের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ কার্যক্রম থেকে বিরত থাকতে হবে।
শুল্কমুক্ত সুবিধার একচেটিয়াতা: যেসব মার্কিন পণ্যে বাংলাদেশ শুল্কমুক্ত সুবিধা দেবে, সেগুলো অন্য কোনো দেশকে দেওয়া যাবে না।

জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান জানান, দ্বিতীয় দফা আলোচনায় একটি প্রাথমিক ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তির প্রস্তাব দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যেখানে তারা নিরাপত্তা উদ্বেগসহ বিভিন্ন বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে চায়।

বাণিজ্য উপদেষ্টার বৈঠকে বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, বাংলাদেশ চেম্বারসহ বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠনের প্রতিনিধি এবং অর্থনীতিবিদরা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে উঠে আসে যে, শুল্ক আলোচনায় বাণিজ্যের বাইরে অন্যান্য বিষয় রয়েছে, তবে গোপনীয়তার চুক্তির কারণে বিস্তারিত আলোচনা করা সম্ভব হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা উদ্বেগ নিয়ে জ্বালানি উপদেষ্টার বক্তব্যের বিষয়টি বৈঠকে উঠে এলেও বাণিজ্য উপদেষ্টা এ বিষয়ে কথা বলতে চাননি। তবে ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা দেশের স্বার্থকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়ার পরামর্শ দেন।

বৈঠকে দরকষাকষির জন্য লবিস্ট নিয়োগের প্রস্তাব এলেও গোপনীয়তার চুক্তির কারণে তা সম্ভব নয় বলে বাণিজ্য উপদেষ্টা জানান। তবে তিনি ব্যবসায়ীদের নিজস্ব উদ্যোগে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানিকারক ও ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর সহযোগিতা নেওয়ার বিষয়ে সবুজ সংকেত দেন।

ব্যবসায়ীরা আরও পরামর্শ দেন যে, শেষ পর্যন্ত পাল্টা শুল্ক যেন প্রতিযোগী দেশ ভিয়েতনাম, ভারত ও কম্বোডিয়ার চেয়ে বেশি না হয়। সরকারের পক্ষ থেকে শুল্ক কিছুটা কমবে বলে আশ্বাস পাওয়া গেছে।

বৈঠকে ব্যবসায়ীরা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে পাঁচ বছর মেয়াদী একটি 'রোডম্যাপ' প্রণয়নের পরামর্শ দিয়েছেন। এতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে কোন কোন পণ্যের আমদানি বাড়ানো যায়, সে বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে, গত বাজেটে তুলা আমদানিতে আরোপিত ২ শতাংশ অগ্রিম আয়কর (এআইটি) প্রত্যাহারের প্রস্তাব দেন ব্যবসায়ীরা, যা সরকার মেনে নিয়েছে এবং এ বিষয়ে যেকোনো দিন প্রজ্ঞাপন জারি হতে পারে।

এছাড়াও, যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা তুলায় উৎপাদিত তৈরি পোশাকে সে দেশে শুল্কমুক্ত সুবিধার প্রস্তাব আলোচনার টেবিলে উত্থাপনের জন্য সরকারকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ দীর্ঘদিন ধরে এ বিষয়ে লবিং করে আসছে।

প্রস্তাবিত চুক্তির আওতায় বাংলাদেশে শুল্কমুক্ত সুবিধা চেয়ে পণ্যের একটি বড় তালিকা পাঠিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ বহু বছর ধরে তুলা, গম, সয়াবিন বীজ ও তেল এবং অন্যান্য কৃষিপণ্যসহ অনেক মার্কিন পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়ে আসছে। নতুন করে কোন কোন পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়া যায়, তা নিয়ে এনবিআর (জাতীয় রাজস্ব বোর্ড) অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে আলোচনা করবে। এ ছাড়া অশুল্ক বাধা, মেধাস্বত্ব, সরকারি কেনাকাটা, ভর্তুকি, শ্রম অধিকারসহ বেশ কিছু ইস্যু সমাধানে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা সমন্বিতভাবে কাজ করছে।

গত ৮ জুলাই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এক চিঠিতে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে জানান যে, ১ আগস্ট থেকে বাংলাদেশের পণ্য আমদানিতে ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হবে। তবে তিনি আলোচনার পথ খোলা রাখার কথাও জানিয়েছেন।

বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এই কৌশলগত দরকষাকষি কতটা সফল হবে, এবং বাণিজ্যের বাইরে যুক্তরাষ্ট্রের চাওয়াগুলো কতটা পূরণ করা সম্ভব হবে, তা আগামী তৃতীয় দফার আলোচনায় স্পষ্ট হবে।


বাংলাধারা/এসআর