যুক্তরাষ্ট্রের চাপ:
জ্বালানি-বিমা-টেলিকমে মালিকানার সীমা উন্মুক্ত চায় ওয়াশিংটন
প্রকাশিত: জুলাই ২১, ২০২৫, ১০:০২ দুপুর

ফাইল ছবি
বাংলাদেশে বিনিয়োগের পথে থাকা বাধাগুলো দূর করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। বিশেষ করে তেল-গ্যাস, বীমা ও টেলিযোগাযোগ খাতে বিদেশি মালিকানার সীমা তুলে দিতে ঢাকার সঙ্গে শুল্ক আলোচনায় এমন শর্ত দিয়েছে ওয়াশিংটন। যুক্তরাষ্ট্র বলছে, এসব খাতে ১০০ শতাংশ মালিকানা এবং দ্রুত মুনাফা প্রত্যাবাসনের নিশ্চয়তা না থাকলে, ভবিষ্যতে বড় বিনিয়োগও আসবে না।
সম্প্রতি ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র দ্বিপাক্ষিক শুল্ক আলোচনায় এসব বিষয় উঠে আসে। বৈঠকে দুই দেশ ভবিষ্যতের বাণিজ্য কাঠামো ও বর্তমান শুল্ক ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলোচনা করে। তবে বেশ কিছু বিষয়ে মতপার্থক্য থেকেই গেছে।
বাংলাদেশে অস্ত্র, পারমাণবিক শক্তি, মুদ্রা ছাপানো এবং বনজ সম্পদ আহরণে বিদেশি বিনিয়োগ নিষিদ্ধ। তবে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও গ্যাস অনুসন্ধানে বেসরকারি বিনিয়োগ চালু রয়েছে। বিপণন ও বিতরণে পুরোপুরি বিদেশি মালিকানা না থাকলেও আংশিক বিদেশি অংশীদারিত্ব রয়েছে টেলিযোগাযোগ ও বীমা খাতে।
এসব বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র চায়- ১০০% মালিকানা উন্মুক্ত করা হোক, যাতে তাদের কোম্পানিগুলো স্বাধীনভাবে ব্যবসা করতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার বিষয়টিকে জাতীয় নিরাপত্তা ও কৌশলগত স্বার্থের সঙ্গে যুক্ত মনে করে।
সরকারের উচ্চপর্যায়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, “তেল-গ্যাস ও টেলিযোগাযোগ খাত যে কোনো দেশের জন্য স্পর্শকাতর। এ খাতের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ বিদেশি কোম্পানির হাতে গেলে ভবিষ্যতে চাপ সৃষ্টির ঝুঁকি থাকে।”
এই বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির সাবেক অধ্যাপক ও বিশিষ্ট বিশ্লেষক আনু মুহাম্মদ বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র একদিকে শুল্ক বাড়িয়ে চাপ সৃষ্টি করছে, আবার অন্যদিকে ব্যবসায়িক সুবিধা আদায়ে চাপ দিচ্ছে। এটি এক ধরনের ব্ল্যাকমেইল।”
তিনি আরও বলেন, “শেভরনের মতো মার্কিন কোম্পানি মাগুরছড়ায় বিপর্যয় ঘটিয়ে এখনও ক্ষতিপূরণ দেয়নি। তবুও তারা নতুন দাবি নিয়ে বসছে। এখন দরকষাকষি হলে, বাংলাদেশ সরকারের উচিৎ এসব অমীমাংসিত বিষয় আগে টেবিলে তোলা।”
আনু মুহাম্মদ বলেন, “দেশের জাতীয় সক্ষমতা, দেশীয় প্রতিষ্ঠান এবং জনগণের স্বার্থ বিবেচনায় নিয়েই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। শতভাগ বিদেশি মালিকানায় রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ ও স্বার্থ রক্ষা দুর্বল হয়ে পড়ে।”
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম বলেন, “বিদেশি কোম্পানিকে অনুমতি দিলে দেশীয় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকেও তেল আমদানির সুযোগ দিতে হবে। এটি করতে গেলে একটি স্বচ্ছ ও দৃঢ় নীতিমালার প্রয়োজন।”
তিনি মনে করেন, “প্রতিযোগিতার মাধ্যমে খাতটি লাভবান হতে পারে। তবে শর্ত হচ্ছে, যথাযথ নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারির মাধ্যমে এটি পরিচালনা করা।”
বাংলাদেশে বর্তমানে ১৭টি খাতে ব্যবসা পরিচালনার জন্য বিদেশিদের মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন প্রয়োজন। এর মধ্যে রয়েছে: বিমান চলাচল, ব্যাংক, কয়লা-গ্যাস অনুসন্ধান ও সরবরাহ, বীমা, বিদ্যুৎ, স্যাটেলাইট চ্যানেল, সমুদ্রবন্দর, ভিওআইপি ও আইপি টেলিফোনসহ গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলো।
যুক্তরাষ্ট্র শুধু মালিকানার সীমা নয়, বাংলাদেশে অবস্থানরত মার্কিন বিনিয়োগকারীদের মুনাফা ও মূলধন প্রত্যাবাসন নিয়েও উদ্বেগ জানিয়েছে। তারা বলছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (IMF) কাছে বাংলাদেশ যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, সে অনুযায়ী বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অর্থ দ্রুত দেশের বাইরে পাঠানোর ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
বিশেষ করে শেভরন ও মেটলাইফের মতো বড় প্রতিষ্ঠানের অর্থ কয়েক বছর ধরে আটকে থাকার বিষয়টি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র অসন্তোষ জানিয়ে আসছে। মেটলাইফ ২০১৯ সালের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রে তাদের মুনাফা পাঠাতে পারেনি, যা কোম্পানির জন্য বড় চাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই বিষয়ে অ্যামচেম বাংলাদেশের সভাপতি সৈয়দ এরশাদ আহমেদ বলেন, “সরকার ইতোমধ্যে শেভরনের পাওনা পরিশোধ করেছে এবং অন্যান্য কোম্পানিকেও অর্থ পাঠানোর অনুমোদন দিয়েছে।”
ওয়াশিংটনের দাবি অনুযায়ী, বাংলাদেশকে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য ‘অনাপত্তি সনদ’ পাওয়ার প্রক্রিয়া সহজ করতে হবে। সেইসঙ্গে মূলধন ও মুনাফা প্রত্যাবাসনের অনুমোদন কত দিনের মধ্যে দেওয়া হবে, তার একটি নির্দিষ্ট সময়সীমাও থাকতে হবে।
এই উদ্দেশ্যে একটি স্বচ্ছ নির্দেশিকা তৈরি করার কথা বলা হয়েছে, যা বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়াবে।
বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য উদার নীতি যেমন জরুরি, তেমনি জাতীয় স্বার্থ ও কৌশলগত নিরাপত্তার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশকে তাই যুক্তরাষ্ট্রের চাহিদার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে নিজেদের সামর্থ্য, অভ্যন্তরীণ নীতি এবং ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা কাঠামোর ওপর।
বাংলাধারা/এসআর