ঐকমত্যের অভাবে সংসদের উচ্চকক্ষ গঠনের প্রস্তাব বাদের পথে
প্রকাশিত: জুলাই ১৬, ২০২৫, ১২:০৮ দুপুর

ছবি: সংগৃহিত
সংসদের উচ্চকক্ষ গঠন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতৈক্য না হওয়ায় প্রস্তাবটি বাদ দেওয়ার চিন্তা করছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। বিশেষ করে উচ্চকক্ষের আসন বণ্টনের পদ্ধতি নিয়ে বিএনপি ও জামায়াতের নেতৃত্বাধীন দুই শিবিরের পার্থক্য দূর করা যাচ্ছে না।
বিএনপিসহ পাঁচটি দল সংসদের নিম্নকক্ষের আসনের অনুপাতে উচ্চকক্ষের আসন বণ্টন চাইলেও জামায়াতে ইসলামী, এনসিপিসহ ২১টি দল চায় ভোটের অনুপাতে (প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন- পিআর পদ্ধতি) আসন বণ্টন। এই দুই অবস্থানের মধ্যে কোনো সমঝোতা না হওয়ায় উচ্চকক্ষের ধারণা বাদ দেওয়ার প্রস্তাব এসেছে কমিশনের সংলাপে।
কমিশন সূত্র জানিয়েছে, বিএনপি অনানুষ্ঠানিকভাবে উচ্চকক্ষের প্রস্তাব ‘পরিত্যক্ত’ করার পক্ষে মত দিয়েছে। কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আগামী সপ্তাহের সংলাপে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানানো হবে।
মঙ্গলবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ১৪তম সংলাপে উচ্চকক্ষ ছাড়াও সংবিধান সংশোধন নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়।
কমিশনের মূল প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ হলে সংবিধান সংশোধনে উভয় কক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা এবং গণভোটের প্রয়োজন হবে। প্রস্তাবনায় উচ্চকক্ষ পিআর পদ্ধতিতে গঠনের কথা ছিল। কিন্তু বিএনপিকে পিআরে রাজি করাতে কমিশন কিছু ছাড়ের প্রস্তাব দেয়, যাতে সংবিধান সংশোধনে উচ্চকক্ষে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা এবং নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে গণভোটের বিধান রাখা হয়। তবুও বিএনপি এতে রাজি হয়নি।
সংলাপে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “নিম্নকক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমে সংবিধান সংশোধনে কারও দ্বিমত নেই। আদালতের রায়ে গণভোটের বিধান ফিরে এসেছে। তাই কোন কোন বিষয়ে গণভোট প্রয়োজন, তা আলোচনার মাধ্যমে ঠিক হতে পারে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার যেন কেউ বাতিল করতে না পারে, সেজন্য এ বিষয়ে গণভোটের বিধান রাখা যেতে পারে।”
জামায়াতও এ বিষয়ে একমত বলে জানিয়েছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, “তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হলে ভবিষ্যতে সেটি পরিবর্তন করতে গণভোট বাধ্যতামূলক হবে।”
পঞ্চম দিনের মতো অনুষ্ঠিত আলোচনায় উচ্চকক্ষ নিয়ে জট খুলছে না। বিএনপির ৩১ দফা ইশতেহারে উচ্চকক্ষের কথা থাকলেও এখন দলটি নিজেদের অবস্থান পুনর্বিবেচনা করছে। মধ্যাহ্ন বিরতিতে জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, “একটি দল বা তিনটি দল না চাইলে উচ্চকক্ষের আলোচনা বন্ধ হয়ে যাওয়া হবে অবিচার। অধিকাংশ দল পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ চায়।”
এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন অভিযোগ করেন, “বিএনপি এবং তাদের মিত্ররা পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষের বিরোধিতা করছে। এখন প্রস্তাবটিই বাতিলের চেষ্টা করছে। মৌলিক সংস্কারে এনসিপি ছাড় দেবে না।”
সংলাপে অংশ নেওয়া ৩০টি দল ও জোটের মধ্যে সিপিবি ও বাসদ ছাড়া বাকি সবাই উচ্চকক্ষের পক্ষে ছিল। এলডিপি প্রস্তাব করেছে, উচ্চকক্ষের ৫০টি আসন নিম্নকক্ষের আসনের অনুপাতে এবং বাকি ৫০টি ভোটের অনুপাতে বণ্টন করতে। তবে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম আপাতত উচ্চকক্ষ চায় না।
ঐকমত্য না থাকায় রাজনৈতিক দলগুলো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার কমিশনের ওপর ছেড়ে দিয়েছে বলে জানিয়েছেন আলী রীয়াজ। তিনি আশা প্রকাশ করেছেন, আগামী সপ্তাহের মধ্যেই আলোচনা করে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যাবে।
আলী রীয়াজ বলেন, “দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠিত না হলে, অথবা গঠিত না হওয়া পর্যন্ত সংবিধান সংশোধনে সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাগবে। তবে সংবিধানের ৮, ৪৮, ৫৬, ১৪২ ধারা এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার-সংক্রান্ত অনুচ্ছেদগুলো সংশোধনে গণভোট বাধ্যতামূলক করতে হবে।”
সংলাপ শেষে বিএনপির সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “ভবিষ্যতে কেউ যেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করতে না পারে, তাই আমরা প্রস্তাব করেছি- এ বিষয়ে কোনো পরিবর্তন করতে হলে গণভোটের মাধ্যমেই করতে হবে।”
তিনি বলেন, “উচ্চকক্ষের নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে এখনো ঐকমত্য হয়নি। নিম্নকক্ষের আসনের অনুপাতে নাকি ভোটের অনুপাতে- এ নিয়ে তীব্র বিতর্ক আছে। দেশের আর্থিক সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। আরেকটি সংসদ গঠন করলে যদি তা নিম্নকক্ষের প্রতিরূপ হয়ে যায়, তাহলে তার প্রয়োজনীয়তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।”
গণভোটের মাধ্যমে মতবিরোধের নিষ্পত্তি চায় জামায়াত। ডা. তাহের বলেন, “যদি কেউ সংস্কার বাধাগ্রস্ত করে, তাহলে একমাত্র পথ গণভোট। জনগণই ঠিক করবে তারা কোন পদ্ধতি চায়, কোন সংস্কার চায়।”
তাহের আরও বলেন, “পিআর পদ্ধতির উচ্চকক্ষ থাকতে হবে, যাতে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোট অনুযায়ী প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়। এতে ছোট দলগুলোরও কণ্ঠ থাকবে উচ্চকক্ষে।”
এনসিপির আখতার হোসেন বলেন, “সংবিধানের প্রস্তাবনা, অনুচ্ছেদ ৪৮, ৫৬ এবং নতুনভাবে সংযোজনযোগ্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার-সংক্রান্ত অনুচ্ছেদ ভবিষ্যতে পরিবর্তন করতে হলে তা গণভোটের মাধ্যমেই করতে হবে। সংবিধান সংশোধনে শুধু নিম্নকক্ষ নয়, উচ্চকক্ষেরও দুই-তৃতীয়াংশ সমর্থন প্রয়োজন।”
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রেসিডিয়াম সদস্য আশরাফ আলী আকন্দ হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, “পিআর পদ্ধতি না হলে আরেকটি গণঅভ্যুত্থান হবে। আমরা প্রহসনের নয়, কার্যকর গণভোট চাই।”
গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, “উচ্চকক্ষ নিয়ে কোনো সমাধানই বের করা যাচ্ছে না।”
আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, “গণভোটসহ মৌলিক কিছু বিষয়ে বিভিন্ন দলের মধ্যে মতপার্থক্য আছে। সবাইকে ঐক্যমতে পৌঁছাতে হবে।”
কমিশন জানিয়েছে, আগামী রোববারের মধ্যে উচ্চকক্ষসহ সব বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত সংহত করে সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে।
বাংলাধারা/এসআর