ফুটবল উন্মাদনায় মুখর ঢাকার জাতীয় স্টেডিয়াম, হামজাদের ম্যাচ দেখতে ছুটে এল হাজারো সমর্থক
প্রকাশিত: জুন ১০, ২০২৫, ০৬:১৪ বিকাল

ছবি: সংগৃহিত
এশিয়ান কাপ বাছাইপর্বে সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে মাঠে নামার কথা বাংলাদেশ দলের, সন্ধ্যা ৭টায়। কিন্তু খেলা শুরুর পাঁচ-ছয় ঘণ্টা আগেই ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামমুখি জনস্রোত নামে। সকাল থেকেই রাজধানীর অলিগলি থেকে মানুষ ছুটে আসে- লক্ষ্য একটাই, নিজেদের চোখের সামনে দেখা ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে খেলা তারকা হামজা চৌধুরী ও তার সঙ্গী শমিত সোম ও ফাহামিদুল ইসলামকে।
স্টেডিয়ামের চারপাশ ঘিরে তখন উৎসবমুখর পরিবেশ। বেলা ২টায় গেট খোলার কথা থাকলেও, ঘণ্টার পর ঘণ্টা আগে থেকেই গেটের সামনে বিশাল লাইন। রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে হাজারো দর্শক অপেক্ষা করছেন প্রবেশের জন্য। গেট খোলার সঙ্গে সঙ্গে গ্যালারিগুলো দ্রুত ভরতে শুরু করে। মাত্র এক ঘণ্টার মধ্যে অর্ধেক গ্যালারি ভর্তি হয়ে যায়। হঠাৎ বিকেল ৪টার দিকে এক পশলা বৃষ্টি নেমে আসলেও ফুটবলপ্রেমীদের উচ্ছ্বাসে ছিটেফোঁটা ভাটা পড়েনি। বৃষ্টিতে ভিজেই তারা অপেক্ষা করে গেছেন প্রিয় দলের খেলা দেখার জন্য।
ভক্তদের সাজসজ্জা, চিৎকার, গান ও প্ল্যাকার্ডে ফুটে উঠেছে তাদের আবেগ। কেউ হাতে, কেউ বা মাথায় বাংলাদেশের পতাকা বেঁধে এসেছেন। একজন সমর্থক নিজেই একটি কবিতা লিখে এনেছেন-
"হামজা-শমিত-ফাহামিদুল, গোল দিতে করিও না ভুল!
তরুণদের অনেকে চুল কেটেছেন হামজার স্টাইল অনুসরণ করে। আরেকটি দল প্ল্যাকার্ডে লিখে এনেছেন- হামজা-শমিত-ফাহামিদুলের ঠিকানা: পদ্মা-মেঘনা-যমুনা! এই প্ল্যাকার্ড যেন বলে দিচ্ছে, দলটির সঙ্গে সারা দেশের আত্মার বন্ধন।
বিকেল ৫টার পর নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে স্টেডিয়ামের গেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। যারা আগেভাগে লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তারাই নিশ্চিত করেন নিজেদের জন্য সোনার টিকিটসদৃশ আসন। গ্যালারিতে তখন যেন ৮০ কিংবা ৯০-এর দশকের সেই উত্তাল আবাহনী-মোহামেডান দ্বৈরথের স্মৃতি ফিরে এসেছে। যারা সেই সময়ের উন্মাদনা দেখেছেন, তারাই বলছেন- এমন জোয়ার অনেক দিন পর দেখলাম।
বাংলাদেশ ফুটবলের সাম্প্রতিক ইতিহাসে এমন উন্মাদনা বিরল। ২০০৩ সালে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে ভারতের বিপক্ষে ফাইনাল ম্যাচের উত্তেজনার পর এবারই হয়তো সবচেয়ে বেশি আলোড়ন তুলেছে কোনো ম্যাচ। এর পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ, দেশের ফুটবলে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের খেলোয়াড় হামজা চৌধুরীর আগমন। ব্রিটিশ-বাংলাদেশি এই মিডফিল্ডার প্রথমবারের মতো দেশের জার্সি গায়ে মাঠে নামছেন। তার সঙ্গে আছেন ইউরোপে বেড়ে ওঠা শমিত সোম ও ফাহামিদুল ইসলাম। এই তিন তরুণের মাঠে থাকা মানেই দেশের ফুটবলে নতুন যুগের সূচনা।
টিকিটের জন্যও ছিল এক প্রকার যুদ্ধ। বাফুফে সীমিতসংখ্যক- মাত্র ১৮,৩০০ টিকিট ছাড়ে, যা মুহূর্তেই বিক্রি হয়ে যায়। অনলাইনে সাইটে ভিড়ের কারণে ক্র্যাশ, সাইবার হামলার অভিযোগ, এবং ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেও অনেকেই টিকিট পাননি। তাই যারা গ্যালারিতে জায়গা করে নিতে পেরেছেন, তাদের কাছে এ যেন স্বপ্নের মতো মুহূর্ত।
যাদের ভাগ্যে টিকিট জোটেনি, তাদের জন্য রয়েছে বড় পর্দার আয়োজন। দেশের বিভিন্ন স্থানে বড় পর্দায় খেলা দেখানোর উদ্যোগ নিয়েছে টি স্পোর্টস। ঢাকার রবীন্দ্র সরোবর, চট্টগ্রামের এম এ আজিজ স্টেডিয়াম, রংপুর, ময়মনসিংহ, সিলেট, খুলনা, বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন জেলা শহরে জমজমাট পরিবেশে খেলা দেখাবে ভক্তরা।
এছাড়া ঢাকার রূপনগর-পল্লবী এলাকায় ১২টি জায়গায় বড় পর্দায় খেলা দেখানোর ব্যবস্থা করেছেন সাবেক অধিনায়ক আমিনুল হক। ঘরোয়া মোড়, দোরেন মোড়, মুসলিম বাজার ঈদগাহ, শহীদ জিয়া মহিলা কলেজ মোড়সহ উল্লেখযোগ্য স্থানগুলোয় চলছে প্রস্তুতি।
সব মিলিয়ে আজকের দিনটা শুধুই একটা ফুটবল ম্যাচ নয়, বরং জাতীয় আবেগের বিস্ফোরণ। ২০২৭ সালের জানুয়ারিতে সৌদি আরবে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া এশিয়ান কাপের মূল পর্বে জায়গা করে নিতে চায় বাংলাদেশ। আর সেই স্বপ্নপথে প্রথম ধাপ আজকের ম্যাচটি। তাই হামজা-শমিত-ফাহামিদুলদের দিকে তাকিয়ে আছে কোটি চোখ- একটি গোল, একটি জয় আর একটি নতুন ভোরের আশায়।
বাংলাদেশের ফুটবলে এক নতুন সূর্যোদয়ের প্রত্যাশায় আজ কাঁপছে জাতীয় স্টেডিয়াম, আর হৃদয়ে বাজছে একটাই সুর- এই মাটির ছেলেরা ফিরে আনুক ফুটবলের হারানো গৌরব!
বাংলাধারা/এসআর